সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন মারা গেছেন

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

বাংলাদেশের লোকসংগীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ফরিদা পারভীন মারা গেছেন। শনিবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

তাঁর মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিনি স্বামী এবং চার সন্তান রেখে গেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সপ্তাহে দুই দিন তাঁকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু ডায়ালাইসিসের পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন চিকিৎসক তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। এর পর থেকে তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বুধবার অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশেষে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি চলে যান না–ফেরার দেশে।

শুরুতে নজরুলসংগীত ও আধুনিক গানে পরিচিতি পেলেও ভাগ্যের এক বাঁক তাঁকে নিয়ে যায় লালনগীতির জগতে। কুষ্টিয়ার এক হোমিও চিকিৎসক তাঁর কণ্ঠে লালনগীতি শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথমে অনীহা থাকলেও বাবার উৎসাহে মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। সেই তালিমের প্রথম গান ছিল “সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন”। দোলপূর্ণিমা উৎসবে গানটি গাওয়ার পর শ্রোতাদের প্রশংসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় তাঁর জীবনে। এরপর থেকে লালনের গানই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান।

১৯৭৩ সালে ঢাকায় রেডিওতে ১৫ মিনিটের একক সংগীত পরিবেশন করেছিলেন তিনি। স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন সমর দাস, কাদের জমিলি, কমল দাশগুপ্ত, আবদুল হামিদ চৌধুরীর মতো বরেণ্য সংগীতজ্ঞেরা। তাঁদের প্রশংসা আজীবনের প্রেরণা হয়ে ছিল তাঁর কাছে।

কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীনের জন্ম ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর নাটোর জেলার সিংড়া থানার শাঔঁল গ্রামে। শাঔঁল হচ্ছে কলম ইউনিয়ন-এর অংশ। ফরিদা পারভীনের বাবা প্রয়াত দেলোয়ার হোসেন পেশায় ছিলেন সাধারণ চিকিৎসক।

মা রৌফা বেগম। ফরিদা পারভীনের স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর। চার সন্তানের মধ্যে এক মেয়ে জিহান ফারিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাশ করেছেন আর তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ইমাম নিমেরি উপল ফিলিপাইনের বাগিও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যায়নরত, মেজ ছেলে ইমাম নাহিল সুমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স পড়ছেন এবং ছোট ছেলে ইমাম নোমানি রাব্বি কুষ্টিয়া থেকে এসএসসি পাশ করেছে।

এর মাঝেই অধ্যাপক আবু জাফরের সাথে তার বিচ্ছেদ হয়। তিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিমের সাথে দ্বিতীয় বারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

তার প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল জীবন কেটেছে বিভিন্ন শহরে। স্কুল জীবনের সূচনা হয়েছিল মাগুরায়। তিনি কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমান সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়) এবং মেহেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন এবং কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৬-৭৯ সালে অনার্স পাঠ করেন। গানের শিক্ষাজীবনেরও হাতখড়ি মাগুরা জেলায়। মাগুরায় তার গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। পরবর্তীতে তিনি কুষ্টিয়ার তখনকার গানের ওস্তাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস এবং ওসমান গণি’র কাছে ক্ল্যাসিক্যাল শেখেন। প্রায় ছয়-সাত বছর তানপুরার সঙ্গে ক্ল্যাসিক্যাল চর্চা করবার পর তিনি নজরুল সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন। তার নজরুল সঙ্গীতের প্রথম গুরু হচ্ছেন কুষ্টিয়ার ওস্তাদ আবদুল কাদের। এরপর তিনি মেহেরপুরে মীর মোজাফফর আলী’র কাছেও নজরুল সঙ্গীত শেখেন। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কন্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলী’র কাছেই প্রথম শেখেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে ফরিদার যোগাযোগ। তখন তিনি কুষ্টিয়াতে থাকতেন। সেখানে তাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন গুরু মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা তার কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শিক্ষার মাধ্যমে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন। পরে মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালন সঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন।

 তার অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে-

  • ১৯৭৬ সালে অচিন পাখি নামে একটি লংপ্লে রেকর্ড বের হয়। স্পন্সার করে ‘শ্রোতার আসর’ বর্তমানে এসিআই কোম্পানি
  • ডন কোম্পানি থেকে ‘লালনগীতি’
  • সারগাম থেকে ‘লালনের গান’
  • দোয়েল প্রডাক্টস থেকে ‘দেশাত্মবোধক/আধুনিক/লালন’ মিলে একটা ক্যাসেট
  • আরশিনগর-এর ব্যানারে লালনের গান ‘আমারে কি রাখবেন গুরু চরণে’
  • বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’
  • আবুল উলাইয়ার পরিবেশনায় ‘আশা পূর্ণ হলো না’
  • ‘লাইভ কনসার্ট ইন জাপান’ নামে একটা এ্যালবাম বের করছে আবুল উলাইয়া
  • তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না
  • সমুদ্রের কূলেতে বসে
  • হিট সঙস অব ফরিদা পারভীন : মিলেনিয়াম /বহুদিন হলো ভেংগেছি ঘর
  • লাইভ কনসার্ট ইন ফ্রান্স

তিনি ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ ২০০৮ এ সেরা সঙ্গীতের জন্য পুরষ্কৃত হন। এছাড়া একুশে পদক ১৯৮৭ এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পদকে ছায়াছবির গানে সেরা কন্ঠদানকারী হিসাবে ১৯৯৩ সালে পদক পেয়েছেন।সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস ও অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার পেয়েছেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *