ক্রিকেটার জাহানারার অভিযোগে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে বিসিবি

■ ক্রীড়া প্রতিবেদক ■

ক্রীড়া সাংবাদিক রিয়াসাত আজিমের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জাতীয় দলের পেসার জাহানারা আলম যৌন হেনস্তার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। যেখানে সাবেক নির্বাচক, সাবেক ইনচার্জ, ম্যানেজারসহ বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিয়েও অভিযোগ তোলেন জাহানারা।

জাহানারা আলম অভিযোগ করেন, ২০২২ বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের নির্বাচক ও ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা মনজুরুল ইসলামের কাছ থেকে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে জাহানারা ইসলাম বলেন, ‘উনি (মনজুরুল ইসলাম) একদিন আমার কাছে আসলেন, আমার কাঁধে হাত রেখে বলছিলেন, তোর পিরিয়ডের কতদিন চলছে। পিরিয়ড শেষ হলে বলিস, আমার দিকটাও তো দেখতে হবে। পিরিয়ড শেষ হলে, যখন ডাকবো চলে আসিস।’ তবে এসব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন মনজুরুল।

শুধু মঞ্জুরুলের বিরুদ্ধেই নয়, জাহানারা আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তাঁর ক্যারিয়ার ‘ধ্বংস করে দেওয়ার’ অভিযোগও তুলেছেন। বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে পরের দেড় বছর পর্যন্ত, সব ঘটনা বিসিবি ও নারী উইংয়ের উচ্চপর্যায়ে জানিয়েও বিশেষ কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানিয়েছেন জাতীয় নারী দলের সাবেক এই অলরাউন্ডার।

১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের হয়ে ১৭টি টেস্ট ও ৩৪টি ওয়ানডে খেলেছেন মঞ্জুরুল। অবসরের পর সাবেক এই বাঁহাতি পেসার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) অধীনে বিভিন্ন দলের কোচিং ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ছিলেন জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের নির্বাচকের দায়িত্বে। একই সময়ে বিভিন্ন সিরিজে দলের ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

সাবেক এই পেসার এখন কাজ করছেন চীনে নারী ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ হিসেবে। আজ তিনি দাবি করেছেন, জাহানারার সব অভিযোগই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। দেশে এসে তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতেও প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন মঞ্জুরুল।

এ বিষয়ে মঞ্জুরুল বলছেন, ম্যানেজার হিসেবে দলের সঙ্গে থাকা ফিজিওর মাধ্যমেই এসব তথ্য তিনি পেতেন। তবে কখনো সরাসরি কোনো খেলোয়াড়কে এসব বিষয়ে নিজে জিজ্ঞেস করেননি।

এসব বিষয়ে কখনো জাহানারাকে জিজ্ঞেস করেছেন কি না জানতে চাইলে মঞ্জুরুল বলেন, ‘একদমই না। কোথায় বলেছি, কবে বলেছি? এটার প্রমাণটা কোথায়! অন্য সতীর্থদের সঙ্গে তো শেয়ার করবে (তেমন হলে)? তাঁরা বলুক!’

জাহানারা অভিযোগ করেছেন, মঞ্জুরুল ইসলাম প্রায়ই খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেওয়ার নামে শারীরিকভাবে স্পর্শ করতেন, এমনকি আলিঙ্গন বা বুকে টেনে ধরতেন।

নারী ক্রিকেটারদের এভাবে মন্দ স্পর্শ করার অভিযোগটিও অস্বীকার করেছেন মঞ্জুরুল। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অথবা বিসিবির যেকোনো তদন্তের মুখোমুখি হতে তৈরি আছেন বলে জানিয়ে জাতীয় দলের সাবেক এই পেসার বলেন, ‘আমি যেকোনো সময় বাংলাদেশে এসে বসতে তৈরি আছি। যখন বলবে, তখনই আসব। আমাকে তদন্ত কমিটি যা বলবে, তা–ই করব।’

সাক্ষাৎকারে জাহানারা দাবি করেছেন, ২০২২ সালে বিসিবিতে একটি চিঠি দিয়ে প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরীকে সবকিছু জানিয়েছেন। তবে মঞ্জুরুলের দাবি, তাঁকে বোর্ডের পক্ষ থেকে যৌন হয়রানি করার বিষয়ে কখনোই কিছু বলা হয়নি।

তাঁর বিরুদ্ধেই কেন অভিযোগ উঠল জানতে চাইলে মঞ্জুরুল বলেন, ‘এটা আমি জানি না। আমার মূল সমস্যা ছিল নিয়মশৃঙ্খলা আর আইনকানুন। এসব বিষয়ে আমি কঠোর ছিলাম। খাওয়ার ব্যাপারে কঠোর থাকতাম। বাইরের কিছু খেলে ওদেরই ক্ষতি। এটা যদি খারাপ কাজ হয়, এটার জন্য যদি শাস্তি হয়, আমার কোনো সমস্যা নেই।’

বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় বিসিবি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিটি ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেবে। বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ইতোমধ্যে কয়েকটি করণীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এ বিষয়ে।

তার মধ্যে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে- 

  • সিইওকে স্পষ্ট করতে হবে তিনি ভুক্তভোগীর কাছ থেকে কোনো লিখিত অভিযোগ পেয়েছিলেন কি না এবং কবে পেয়েছিলেন। যদি পেয়ে থাকেন, তবে কেন তিনি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি তা ব্যাখ্যা করতে হবে।
  • অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যদি এখনো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) কর্মরত থাকেন, তবে সিইওকে অবিলম্বে তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে হবে।
  • সিইওকে আইন বিভাগ (লিগ্যাল টিম)-এর সহযোগিতায় দুই সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। তদন্তের অগ্রগতি বোর্ডে প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে হবে। তদন্তের ভিত্তিতে সিইও ভুক্তভোগীকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেবেন।
  • সিইওকে ক্রিকেট অপারেশন্স/মহিলা উইং-এর সঙ্গে যৌথভাবে নারী খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সংক্রান্ত বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলো পর্যালোচনা করতে হবে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে এর প্রতিবেদন বোর্ডে জমা দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় মহিলা উইং-এর পরিচালককে অবহিত রাখতে হবে।

এ বিষয়ে গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। গতকাল (বৃহস্পতিবার) দিবাগত রাত প্রায় পৌনে ১২টার সময় দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সাবেক বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের এক সদস্যের মাধ্যমে গণমাধ্যমে উত্থাপিত কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে। বিসিবি সর্বদা তার খেলোয়াড় ও কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ, সম্মানজনক ও পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। বোর্ড এ ধরনের বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখে এবং তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

এতে বলা হয়, তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বিসিবি সকল পক্ষকে, বিশেষ করে গণমাধ্যমকে, অনুমাননির্ভর মন্তব্য বা প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছে, যাতে তদন্ত প্রক্রিয়া কোনোভাবে প্রভাবিত না হয়।

স্বাধীন তদন্ত কমিশনের আহ্বান জানিয়েছেন তামিম

নারী পেসারের পাশে দাঁড়িয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। এবার সরব হলেন আরেক সাবেক কাপ্তান মাশরাফি বিন মোর্ত্তজাও। 

শুক্রবার দুপুরের পর নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে মাশরাফি লিখেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট ও গোটা ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থে জাহানারা আলমের প্রতিটি অভিযোগ বিসিবি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে আশা করি। 

আরও লিখেছেন, আশা করি, বিসিবির তদন্ত কমিটি পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে এবং অভিযোগের সত্যতা পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে, যেন এসবের পুনরাবৃত্তি আর কখনো না হয়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন নিরাপদ হোক সবার জন্য।

এর আগে তামিম এক পোস্টে লিখেছিলেন,  জাহানারা আলম যে অভিযোগগুলো তুলেছেন, সবগুলোই গুরুতর এবং সেসব সত্যি হলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। শুধু একজন জাতীয় ক্রিকেটার বা সাবেক অধিনায়ক বলেই নয়, যে কোনো পর্যায়ের ক্রিকেটার হোক বা যে কোনো খেলার ক্রীড়াবিদ কিংবা যে কোনো নারী, কারো প্রতিই এমন আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিসিবি সংশ্লিষ্টদের বাইরে রেখে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন তামিম। তিনি বলেন, বিসিবি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বটে। তবে আমি মনে করি, এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কিংবা সরকারী পর্যায়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত, যেখানে বিসিবি সংশ্লিষ্ট কেউ থাকবেন না, যাতে বিন্দুমাত্র পক্ষপাতের সুযোগ না থাকে। যত দ্রুত সম্ভব এই কমিটি গঠন করা উচিত ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটিকে দেখা উচিত। দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত শেষ করে দোষী যে-ই হোক, যার যতটুকু দায় থাকুক, উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

ইতোপূর্বে আরও যারা এমন হেনস্থার শিকার হয়েছেন সবাইকে সাহস নিয়ে মুখ খোলার অনুরোধ জানিয়েছেন তামিম। তিনি বলেন, জাহানারার অভিযাগের পর আরও বেশ কিছু ঘটনার কথা জানতে পারছি নানা মাধ্যমে। আমি প্রতিটি নারী ক্রিকেটারকে অনুরোধ করব, যারা নানা সময়ে এসব ঘটনার শিকার হয়েছেন, সেটা সরাসরি হোক বা আকারে-ইঙ্গিতে, যে কোনোভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছে, সবাই মুখ খুলবেন এবং সাহস নিয়ে এগিয়ে আসবেন। দেশের ক্রিকেট তথা ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থে, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে এটা প্রয়োজন। কথা দিচ্ছি, আমাকে ও আমাদেরকে আপনাদের পাশে পাবেন। 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *