:: বুয়েট প্রতিনিধি ::
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে গভীর রাতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রবেশের ঘটনার প্রতিবাদে রোববার তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করে ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত হলে শ্রেণিকক্ষে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন।
বুয়েট ক্যাম্পাসের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে রোববার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে এসব বক্তব্য তুলে ধরা হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনজন লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মতাদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। লিখিত বক্তব্যে তাঁরা বলেছেন, ‘ক্ষমতার লোভ এবং অপচর্চা আবারও এসে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে না ফেলুক। আমরা সব শিক্ষার্থীই গর্বের সঙ্গে আমাদের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনার চর্চা আমাদের অন্তরে লালন করি।
এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন ঠিক কখন শুরু হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে আশা করা হচ্ছে ছাত্রলীগের সমাবেশ শেষ হলেই তা শুরু হবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেলা ৩-৪টার দিকে সংবাদ সম্মেলন শুরু হতে পারে।
সকাল সাতটা থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের জড়ো হওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা সেখানে যাননি। পরে বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁরা।
এর আগে আজ দুপুরে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন চালুর দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন। বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরে এই সমাবেশ হয়। পরে সমাবেশ শেষে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে যান এবং কিছু সময় শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করেন।
বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ছাত্ররাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের পক্ষে আন্দোলনরত সব ব্যাচের সব শিক্ষার্থী রোববার নিরাপত্তাজনিত তীব্র শঙ্কার কারণে কেউ কোনো ধরনের সমাগম করেননি। ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় শনিবার রাত থেকে ক্রমাগত মাইকিং, শিক্ষার্থীদের ফোন কলে হুমকি–ধমকি দেওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রকম গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের মিথ্যা ‘ট্যাগ’ (পরিচিতি দেওয়া) দেওয়া, শিক্ষার্থীদের ছবি-নাম-পরিচয়সহ পোস্ট করে তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়, এমন সব অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এ অবস্থায় বুয়েট ক্যাম্পাস এবং আশপাশের এলাকা বুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এমনকি বুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরেও শিক্ষার্থীরা তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নিরাপত্তাজনিত এসব বিষয়ে বুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে অবস্থান না নেওয়া মানে এই নয় যে ছাত্ররাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবি থেকে বুয়েট শিক্ষার্থীরা সরে এসেছেন। তাঁদের অবস্থান কোনো একক ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়, বরং বুয়েট ক্যাম্পাসে দেশের সব ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ছাত্ররাজনীতির উপস্থিতি ছাড়াও সুস্থ নেতৃত্ব এবং নৈতিকতা বিকাশের সব উপাদান ক্যাম্পাসে গত কয়েক বছর উপস্থিত ছিল। সুস্থ নেতৃত্ব চর্চার জন্য শিক্ষার্থীরা তাঁদের উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে।
বুয়েটের সব শিক্ষার্থী গর্বের সঙ্গে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনার চর্চা অন্তরে লালন করেন বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, বুয়েটের সব শিক্ষার্থী সম্মিলিতভাবে দেশবাসীর সামনে সৎ সাহসের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বলতে চায়, ‘বুয়েটের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা, তার সঙ্গে বুয়েটের সব শিক্ষার্থীই একাত্মতা পোষণ করে।’
নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রমের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্যাম্পাসে এদের কর্মকাণ্ড দেখা যায় বহিরাগতদের লাগানো বিভিন্ন পোস্টার, ই–মেইল বা প্রচারপত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে। কারা এগুলো করেন, তাঁদের পরিচয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট নন। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা হিযবুত তাহরীরের সম্পূর্ণ বিপক্ষে উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এ–জাতীয় অপশক্তির উত্থান যেন বুয়েটে না হয়, সে জন্য তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ছাত্রশিবিরের রাজনীতি প্রসঙ্গে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘যেসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শিবিরের কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগ আসছে, তাঁদের ঘটনাটি বুয়েটের বাইরে হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত এই ঘটনার বিষয়ে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবে অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাঁদের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিতভাবে আহ্বান জানাই এবং এটি আমাদের পূর্বের একটি আন্দোলনের অন্যতম দাবি হিসেবে ছিল।’
২০১৯ সালের অক্টোবরে আবরার ফাহাদ হত্যার পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। তবে গত বছর বুয়েট শিক্ষার্থীদের পদ দিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হলে বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা তৈরি হয়। তখন ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পুরোনো বিজ্ঞপ্তিটি আবার বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে প্রচার করা হয়।
এ পরিস্থিতিতে বুধবার (২৭ মার্চ) রাত ১টার দিকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। তাদের অভিযোগ, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেছে।
এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে শনিবার বিকালে বুয়েট প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীরা লিখিত আকারে ৬ দফা দাবি জানান।
লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করা হয়, বুধবার মধ্যরাতের পর ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগতদের’ প্রবেশ ও রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক হলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র ইমতিয়াজ হোসেন।
তাই আন্দোলনকারীদের দাবি, ইমতিয়াজকে বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার, হলের সিট বাতিলসহ তার সহযোগীদেরও বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করতে হবে।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে দিচ্ছে তার ব্যাখ্যাও চেয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) পদত্যাগ দাবি করেছেন তারা। এসব দাবি আদায়ে শনি ও রোববারের পরীক্ষাসহ সব অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা।