■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের গুলশানের আলিশান ডুপ্লেক্স বাসায় থাকা তার পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিলামে তোলা হবে।
বেনজীর গুলশানের র্যানকন আইকন টাওয়ারে ফ্ল্যাট নং ১২/এ, ১২/বি, ১৩/এ, ১৩/বি এই চারটি আলিশান ফ্ল্যাটকে একত্রিত করে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট তৈরি করেন বেনজীর দম্পতি। একটি আলিশান ডুপ্লেক্স ইউনিট করেছিলেন। সেখানে পাওয়া ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিলামে তোলার জন্য নিলাম কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গত সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিলামে তোলা হবে। কমিটি নিলাম প্রক্রিয়ার মানদণ্ড ঠিক করেছে এবং নিলামপ্রক্রিয়া সম্পন্নের ব্যবস্থা নিয়েছে।
কমিটিতে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের পরিচালককে সভাপতি এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিনিধি, বস্ত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের একজন প্রতিনিধি, ইস্পাত প্রকৌশল অধিদপ্তরের চেয়ারম্যানের একজন প্রতিনিধি সদস্য থাকবেন। দুদকের উপ-পরিচালক (সম্পদ ব্যবস্থাপনা) সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। আদালত কমিটি গঠন করার পর ওই ফ্ল্যাটে ব্যবহৃত সম্পদের তালিকা (ইনভেনট্রি) প্রস্তুত করেছে।
বেনজীর দম্পতি গুলশানের র্যানকন টাওয়ারের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে সুইমিংপুল, মিনি থিয়েটার রুম, অতিথি বিনোদন রুম ও বৈঠকখানাসহ আধুনিক অভিজাতপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান টিম জানায়, পুরো ফ্ল্যাটে ১৯টি ফ্রিজ রয়েছে। এসি রয়েছে সব মিলিয়ে ১০০ টন, সুইমিংপুলে ব্যবহৃত আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ আছে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী। ফ্ল্যাটের খাট, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল, সোফা, চেয়ার, আলমারি, ওয়ার্ডরোবসহ মূল্যবান সামগ্রী নিলামবহির্ভূত রাখা হয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে পরে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এরই মধ্যে সম্পদের জব্দ-তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় মোট ২৪৬টি আইটেমের জিনিসপত্র রয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শার্ট ১২২টি, প্যান্ট ২৬৬টি, ৩০টি ব্লেজার, আটটি স্যুট, টি-শার্ট ৭২২টি, পাঞ্জাবি ২২৪টি, পায়জামা ৪৭টি, স্যান্ডেল ৮৮ জোড়া, কেডস ৩৫ জোড়া, জুতা ৩৮ জোড়া, শাড়ি ৪৯৪টি, থ্রিপিস ২৫০ সেট, সালোয়ার-কামিজ ৪৯৬টি, ব্লাউজ ৬৫টি, জামা ২১২টি, জ্যাকেট ৫৬টি, বেডশিট ১০৯টি, লেডিস ভ্যানিটি ব্যাগ ৭৫টি, লেডিস টপস ৬২২টি, পুরুষের সোয়েটার ১১টি, লেডিস সোয়েটার ৩৪টি, লেডিস প্যান্ট ৩৫৫টি, লেডিস টি-শার্ট ২৮টি, নাইট ড্রেস ৫৮টি, ওড়না ৩৪৭টি, শাল-চাদর ৮৯টি, শীতের জামা ১৩২টি, লেহেঙ্গা ১৬টি, সানগ্লাস ৩৪টি, ট্রাউজার ৬৭টি।
সেন্ট-পারফিউম ছাড়াও ড্রয়িং রুম, বৈঠকখানা, থিয়েটার রুম, করিডোর বৈঠকখানা, কিচেন রুম, মাস্টার বেডসহ অন্য বেডরুমে ব্যবহৃত জিনিসপত্র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ২০২৪ সালের ৪ মে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে বেনজীর আহমেদ স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে গোপনে দেশ ছাড়েন।
দুদকের তদন্ত টিম এবং নিলাম কমিটির সদস্যদের মতে বেনজীর দম্পতি পালিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাগ ভরে স্বর্ণালংকার, টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে গেছেন। ইতোমধ্যে ১১ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাচারের অভিযোগে বেনজীরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
অর্থপাচার ও পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলা ছাড়াও তার স্ত্রী জিশান মীর্জা, বড় কন্যা ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর ও ছোট মেয়ে তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীর-এর বিরুদ্ধে ৭৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন করায় পৃথক চারটি মামলা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর এসব মামলা করে দুদক।
এর মধ্যে বেনজীর আহমেদ ৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, ২ কোটি ৬২ লাখ টাকার তথ্য গোপন; স্ত্রী জীশান মির্জা ৩১ কোটি ৬৯ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন, ১৬ কোটি ১ লাখ টাকার তথ্য গোপন; বড় মেয়ে ফারহীন ৮ কোটি ৭৫ লাখ এবং ছোট মেয়ে তাহসীন ৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তথ্য গোপন করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
বেনজীর আহমেদ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজিপি ছিলেন।
ইনভেন্ট্রি কমিটির একজন সদস্য জানান, ফ্ল্যাটের ব্যবহৃত জিনিসপত্র তালিকা করার সময় মনে হয়েছে আমরা মার্কোস ও ইমেলদা মার্কোসের সম্পদের তালিকা তৈরি করছি। আশির দশকে দুনিয়া কাঁপানো মার্কোস দম্পতির কথা মনে পড়ে গেল। ইমেলদা মার্কেটের জুতা, ব্যবহৃত পোশাক, অন্যান্য সামগ্রী ও প্রসাধনের মুখরোচক সংবাদ ওই সময় আলোচিত ছিল। এ যেন বেনজীর দম্পতির সঙ্গে ফিলিপাইনের মার্কোস দম্পতির রাশি জাতকের মিল।
গোপালগঞ্জের অধিবাসী বেনজীর আহমদ গণরোষে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, এলিট ফোর্স র্যাবের মহাপরিচালকসহ প্রাইজ পোস্টিংগুলো উপভোগ করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি তৎকালীন সরকারের আনুগত্য লাভের জন্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন, মামলা, গুম, খুন, রাতের ভোটের নির্বাচনের কারিগরদের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। শেখ হাসিনা পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগেই দেশের রাজনৈতিক বৈরী আবহাওয়া বুঝতে পেরে বেনজীর আহমেদ গোপনে জাল পাসপোর্ট করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পাসপোর্ট করার অভিযোগে দুদক তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে।