■ গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি ■
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে হামলা-সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। এ সময় ১২ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গোপালগঞ্জে ২২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গীপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪)। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জ্বীবিতেশ বিশ্বাস। তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বেশ কয়েকজন হাসপাতালে আনা হয়েছিল।
বুধবার (১৬ জুলাই) সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়।
বার্তায় বলা হয়, আজ বুধবার রাত ৮টা থেকে পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া অস্থিরতা ও সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কারফিউ চলাকালীন সময়ে জনসাধারণের চলাচল সীমিত থাকবে এবং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হতে পারবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে থাকবে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।
মাসব্যাপী এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ গোপালগঞ্জে পদযাত্রা ছিল এনসিপির। গতকাল মঙ্গলবার দলের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এই কর্মসূচিকে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ নাম দেওয়া হয়।
এই কর্মসূচি ঘিরে গোপালগঞ্জ সদরে আজ সকালে পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। কাছাকাছি সময়ে হামলা করা হয় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি বহরেও। এ দুই ঘটনায় স্থানীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে জানায় গোপালগঞ্জ পুলিশ।
দুপুর ১টা ৩৫ মনিটের দিকে গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় এনসিপির সমাবেশ মঞ্চে হামলা চালায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তারা মঞ্চে থাকা সাউন্ড বক্স, মাইক ও চেয়ার ভাঙচুর করেন এবং উপস্থিত এনসিপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এনসিপির নেতাকর্মীরা পুলিশের সহায়তায় সেখান থেকে সরে যান।
এ ঘটনার আধা ঘণ্টা পরে ওই সমাবেশ স্থলেই পুলিশি নিরপত্তায় সমাবেশ করে এনসিপি। সেখানে নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম ও আখতার হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশ শেষ হওয়ার পর এনসিপির নেতারা যখন গাড়ি বহর নিয়ে মাদারীপুর রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন আবার ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় পুলিশও পিছু হটে। এনসিপির নেতাকর্মীরা পালিয়ে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। হামলাকারীরা এনসিপির সমাবেশ মঞ্চ এবং আশপাশের বিভিন্ন স্থানে চেয়ার-টেবিল ও আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর থেকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে হামলাকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। গোপালগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্থানে এ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় বিজিবি। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও বাড়তি জনবল নিয়োজিত করা হয়। বিকেলের দিকে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা ও ভাঙচুরের খবর পাওয়া যায়। এরপর সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ একযোগে হামলাকারীদের সরাতে অভিযান শুরু করে।
সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে গোপালগঞ্জ ছাড়লেন এনসিপির নেতারা
গোপালগঞ্জে গিয়ে হামলার মুখে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবস্থান নেওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে (এপিসি) করে সেখান থেকে বের হন। পরে তাঁরা সাঁজোয়া যানে করেই গোপালগঞ্জ থেকে বের হতে পেরেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
বুধবার বিকেলে গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে সমাবেশ শেষে এনসিপির নেতা-কর্মীদের ঘিরে হামলার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ এই হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এনসিপির নেতা-কর্মীরা।
ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এনসিপির সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে একদল ব্যক্তি লাঠিসোঁটা নিয়ে নেতা-কর্মীদের ঘিরে হামলা চালান। তাঁরা চারদিক থেকে এনসিপির নেতা-কর্মী ও পুলিশের গাড়ি আটকে দেন। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এনসিপির নেতা-কর্মীরা অন্যদিক দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
এনসিপির নেতারা তখন গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অবস্থান নেন। বিকেলে এনসিপির নেতারা যে সাঁজোয়া যানে করে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে বের হন, এমন কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাঁজোয়া যানে উঠছেন।
জেলা পুলিশ কার্যালয়ে অবস্থানের সময় এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। এ সময় পুলিশ-সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তাঁদের (এনসিপির নেতা) বলা হয়েছিল, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা সমাবেশস্থলে এসে দেখেন, পরিস্থিতি ঠিক নেই।

মুজিববাদীরা বাধা দিয়েছে, জবাব দেয়া হবে: নাহিদ
ওদিকে গোপালগঞ্জের পদযাত্রা ও সমাবেশে ‘মুজিববাদীরা’ বাধা দিয়েছে, তার জবাব দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। দফায় দফায় হামলা ও ভাঙচুরের পর গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় সমাবেশ মঞ্চে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, ‘মুজিববাদীরা’ আজকে বাধা দিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে আমরা বলেছিলাম, বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই, সেই লড়াইয়ে জিততে হবে। এবং সেই লড়াইয়ে আমরা জিতেছিলাম। আজকে আমাদের বাধা দেয়া হয়েছে। অচিরেই আমরা এর জবাব দেবো ইনশাআল্লাহ। নাহিদ বলেন, ‘যারা গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে, নতুন বাংলাদেশের পক্ষে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। এই গোপালগঞ্জ যেন আর ‘মুজিববাদী’দের কেন্দ্র হয়ে উঠতে না পারে। যদি পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, নিজেদের জেলার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব, বাংলাদেশকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। যেমন আমরা গণ-অভ্যুত্থানে নিয়েছিলাম।
এনসিপি নেতা বলেন, আমরা ঘোষণা দিলে সারা বাংলাদেশ এই গোপালগঞ্জে এসে জড়ো হবে। কিন্তু আমরা সময় দিয়ে যাচ্ছি। আজকে যে হামলা হলো, কোন সাহসে বাধা দেয়া হয়েছে, কোন সাহসে ‘মুজিববাদীরা’ গোপালগঞ্জে এখনো আশ্রিত হয়ে আছে, কারা আশ্রয় দিয়েছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি এর সামধান না হয়, তাহলে আমরা আবারো আসবো গোপালগঞ্জে। আমরা নিজ হাতে দায়িত্ব নিয়ে গোপালগঞ্জকে ‘মুজিববাদী’দের হাত থেকে মুক্ত করবো ইনশাআল্লাহ। মুজিববাদীদের কবর রচনা করে, বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচনা করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলবো, এটা আমাদের আপনাদের কাছে ওয়াদা।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে গোপালগঞ্জসহ সারা দেশে ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের’ গ্রেফতারের দাবি
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গোপালগঞ্জসহ সারা দেশে ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের’ গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ ছাড়া অবিলম্বে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জারির দাবি তুলেছে সংগঠনটি। বুধবার রাজধানীর শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি এই দাবিসহ তিন দফা দাবি জানায়। সরকার এসব দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি রিফাত রশিদ। তিনি বলেন, গোপালগঞ্জে যা শুরু হয়েছে, সেখানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা এবং দিল্লি, এদের চক্রান্তে গোপালগঞ্জের মধ্যে একটি প্রক্সি স্টেট কায়েম করেছে। সেখানকার সার্বভৌমত্ব নিয়ন্ত্রণ করছে স্বৈরাচারী হাসিনা এবং দিল্লির মসনদে বসে থাকা ওই লুটেরারা, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বকে সবসময় ছিনিয়ে নিতে চায়। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এই প্রক্সি স্টেট খেলা আমরা হতে দিবো না। সংগঠনের তরফে তিন দফা দাবি তুলে ধরেন তিনি। দাবিগুলো হচ্ছে- অবিলম্বে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জারি করতে হবে। ‘আওয়ামী পুলিশি’ কাঠামো ভেঙে ফেলে পুরো ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গোপালগঞ্জসহ সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে সক্রিয় সকল আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধীদের এসব দাবি সরকার মেনে না নিলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন রিফাত রশিদ।
গোপালগঞ্জ জেলায় বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত
গোপালগঞ্জ জেলায় কারফিউ জারি করায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকালে অনুষ্ঠেয় এইচএসসি পরীক্ষা কেবল ওই জেলার জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তবে দেশের অন্যান্য জায়গায় পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আগামীকালের পরীক্ষা যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গোপালগঞ্জ এ শিক্ষা বোর্ডের অধীন।
আগামীকাল সকালে এইচএসসিতে ভূগোল (তত্বীয়) দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা আছে। সময়সূচি অনুযায়ী আগামীকাল বিকেলেও একাধিক বিষয়ের পরীক্ষা থাকলেও গোপালগঞ্জ জেলায় সেসব বিষয়ের পরীক্ষা নেই।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গোপালগঞ্জ জেলায় স্থগিত ভূগোল (তত্ত্বীয়) দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার পরিবর্ততি সময়সূচি পরে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।