■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ উপকূলের আরও কাছে চলে এসেছে। তবে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ‘ডানা’র তাণ্ডব চালানোর আশঙ্কা নেই বলে জানিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ সাংবাদিকদের জানান, ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের সমতলে প্রবেশ করার কোনো আশঙ্কা নেই।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ডানা বুধবার রাত ৩টার দিকে শক্তিশালী হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে বৃহস্পতি-শুক্রবার খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। তখন বাতাসের গতিবেগ ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার থাকতে পারে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’ পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৪৭৫ কিমি দূরে অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর উপর দিয়ে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকালে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিকের দেওয়া আবহাওয়ার ৯ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ আরও উত্তর- উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় (১৮.৪° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.০° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টি আজ সকাল ৬টায় (২৪ অক্টোবর) চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৯৫ কিমি দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৫৫৫ কিমি দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৮৫ কিমি দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৭৫ কিমি দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল।
বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের ওপর দিয়ে দমকা/ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারি (৪৪-৮৮ মি.মি.) থেকে অতিভারি (≥ ৮৯ মি.মি.) বর্ষণ হতে পারে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিমি এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিমি, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ১১০ কিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে ০৩ (তিন) নম্বর (পুনঃ) ০৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ হারবার মাস্টার কমান্ডার সাইফুর রহমান ভূইয়া বলেন, সতর্ক অবস্থায় থেকে বন্দরে অবস্থানরত বাণিজ্যিক জাহাজ ও জেটিতে বাণিজ্যিক কার্যকম স্বাভাবিক রেখেছে কর্তৃপক্ষ। তবে বৃষ্টির কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ। বুধবার থেকে আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে মিল রেখে তাদের নিজস্ব অ্যালার্ট-১ জারি করে। আবহাওয়া অফিস যখন তাদের সিগন্যাল বাড়াবে তখন মোংলা বন্দর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে বন্দরের নিজস্ব টুইন জাহাজ, পানির বোর্ড ও পাইলট বোর্ডগুলো জেটিতে নিরাপদে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষে একটি কন্ট্রোল রুম (নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) খোলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের নৌবাহিনীর জেটিটি ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাবে জোয়ারের পানির তোড়ে একটি বার্জের ধাক্কায় এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। জেটি ভেঙে যাওয়ায় সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণেও দেখা দিয়েছে আরেক বিপত্তি।
বৃহস্পতিবার সকালে জেটি ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) তানভীর হোসেন। তিনি জানান, কি কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে তা বিস্তারিত জানাব চেষ্টা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উত্তাল রয়েছে সাগর। গতরাত ২/৩ টার সময় ছিল পূর্ণ জোয়ার। এ সময় ঢেউয়ের প্রচণ্ড তোড়ে জেটির সাথে বাঁধা একটি ছোট বার্জের ধাক্কায় জেটিটি ভেঙে যায়।
জেটিঘাটের চা দোকানি আবদুল মাজেদ জানিয়েছেন, বার্জটি জেটির সাথে বেঁধে রাখায় মধ্যরাত থেকে বাতাসের ধাক্কায় বড় বড় আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল। কিন্তু এ সময় কেউ জেটিতে এবং বার্জে ছিল না। এমনকি রাত ২/৩ টার দিকে জেটি ভেঙে যাওয়ার পরও সকাল ১০ টা পর্যন্ত কোন লোককে জেটির আশেপাশে দেখা যায়নি।
জেটি সংলগ্ন তারকা হোটেল রয়েল টিউলিপের বৈদ্যুতিক শাখার একজন কর্মী জানিয়েছেন, গত কয়েকদিন ধরে ছোট আকারের তিনটি নৌযান জেটিতে কি জানি কাজ করছিল। এসব নৌযান গুলো সরিয়ে না রাখার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।
ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র প্রভাবে বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ
ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র প্রভাবের কারণে ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। বিআইডব্লিউটিএ জানায়, ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে সমুদ্রে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত ও নদী বন্দরগুলোতে দুই নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) বেলা সোয়া ১১টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নদী বন্দর কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের উপপরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র প্রভাবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে বরিশাল নদীবন্দরে ২ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এতে বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হলেও ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ চলাচলের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আবহাওয়া পরিস্থিতি বুঝে ঢাকা-বরিশাল রুটের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে।
এদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বরিশালে বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নগরীর বিভিন্ন এলাকা। বৃষ্টির কারণে অনেকেই প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হতে পারছেন না।
উপকূল থেকে ১০ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষকে সরিয়ে নিচ্ছে ওড়িশা
প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র কারণে ওড়িশা রাজ্যের ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন থেকে মোট ১০ লাখ ৬০ হাজার ৩৩৬ জন মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
ইতোমধ্যে ৪ লাখেরও বেশি মানুষকে স্থায়ী-অস্থায়ী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিদেরও আজ বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ওড়িশা রাজ্য সরকারের কর ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক মন্ত্রী সুরেশ পূজারী।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সুরেশ পূজারী বলেন, “রাজ্যের ১৪টি জেলার ৩ হাজারেরও বেশি গ্রাম ও এলাকা ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব গ্রাম/এলাকা থেকে আমরা ১০ লাখ ৬০ হাজার ৩৩৬ জনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছি। ইতোমধ্যে ৪ লাখেরও বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, বাকিদেরও আজ বৃহস্পতিবার দুপুরের আগেই সরানো হবে।”
সুরেশ পূজারি আরও জানান, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টার মধ্যে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
পূর্ব-মধ্যবঙ্গপোসাগরের একটি নিম্নচাপ থেকে উদ্ভূত ডানা ইতোমধ্যে প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। ভারতের আবহাওয়া দপ্তরের (আইএমডি) তথ্য অনুযায়ী আজ ২৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাতে ওড়িশার ভিতরকনিকা এবং ধামরার মধ্যবর্তী উপকূলে আছড়ে পড়বে দানা।
এর আগে গত মঙ্গলবারের পূর্বাভাসে ওড়িশার ১৪টি জেলা সতর্কতা জারি করে ভারতের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তর। এই জেলাগুলো হলো গাঞ্জাম, পুরি, জগৎসিংপুর, কেন্দ্রপাড়া, ভদ্রক, বালাসুর, ময়ূরভঞ্জ, কেওনঝাড়, ধেনকানাল, জাজপুর, আঙ্গুল, খোরদহ, নয়াগড় এবং কুট্টাক।
আইএমডির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ওড়িশার স্থলভাগে ডানা আছড়ে পড়ার পর এই ১৪ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ৬০ কিলোমিটার থেকে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। এ সময় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে পূর্বাভাসে।
ওড়িশা রাজ্য সরকারের আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই ১৪ জেলার মধ্যে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে জগৎসিংপুর, কেন্দ্রপাড়া, ভদ্রক এবং বালাসুর।