■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়েরপন্থী ও সাদপন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ জন।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিব ইস্কান্দার এ খবর নিশ্চিত করেছেন।
সংঘর্ষে নিহতরা হলেন—তাবলিগ জামাতের বাংলাদেশি নেতা মাওলানা জুবায়েরের অনুসারী কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানার আমিনুল ইসলাম বাচ্চু (৫৫) ও ঢাকা জেলার দক্ষিণখান থানার বেরাইদ এলাকার বেলাল (৬০), ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারী বগুড়া জেলার তাইজুল ইসলাম (৬৫) (সায়েম)। আরেকজনের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আর আহতদের মধ্যে রয়েছেন আ. রউফ (৫৫) বি বাড়িয়া, মজিবুর রহমান (৫৮) ময়মনসিংহ, আ. হান্নান (৬০), জহুরুল ইসলাম (৩৮) টঙ্গী, আরিফ (৩৪) গোপালগঞ্জ, ফয়সাল (২৮) সাভার, তরিকুল (৪২) নরসিংদী, সাহেদ (৪৪) চট্রগ্রাম, উকিল মিয়া (৫৮) নরসিংদী, পান্ত ( ৫৫) টঙ্গী, খোরশেদ আলম (৫০), বেলাল (৩৪) কেরানীগঞ্জ, আনোয়ার (৫০) নারায়ণগঞ্জ, আবু বক্কর (৫৯) নারায়ণগঞ্জ, আরিফুল ইসলাম (৫০), আনোয়ার (২৬) সাভার, আনোয়ার (৭৬) নোয়াখালী সদর, ফোরকান আহমেদ (৩৫), সাতক্ষিরা, আ.রউফ (৫৫) বি বাড়িয়া, মজিবুর রহমান (৫৮) ময়মনসিংহ, আ. হান্নান (৬০) গাজীপুর, জহুরুল ইসলাম (৩৮) টঙ্গী, সাহেদ (৪৪) চট্রগ্রাম। অন্যদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
বুধবার ভোর ৪টার দিকে তাবলিগ জামাতের জুবায়েরপন্থী ও সাদপন্থীদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
মাওলানা জুবায়ের অনুসারীদের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত জোড় ইজতেমা পালন করেন কয়েক হাজার মুসল্লি। এরপর দ্বিতীয় ধাপে আগামী ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বরে জোড় ইজতেমায় আয়োজনের অনুমতি চান ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির পক্ষের আয়োজক কমিটির (বাংলাদেশের) শীর্ষ মুরব্বিরা। তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে সাদ অনুসারীদের দ্বিতীয় দফায় জোড় ইজতেমার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
কয়েক দিন ধরে সরকার ও মাওলানা জুবায়ের অনুসারী ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরব্বিদের কাছে দফায় দফায় জোড় ইজতেমা করার অনুমতি চান মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারী ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরব্বিরা।
গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির ইজতেমা আয়োজক কমিটির কয়েকজন শীর্ষ মুরব্বি গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে যান। সেখানে আলোচনা শেষে দুপুরে ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশ দিয়ে বিশ্ব ইজতেমা মসজিদে ফিরছিলেন সাদপন্থী মুরব্বিরা। টঙ্গীর মুন্নু গেট এলাকায় পৌঁছালে আগে থেকেই লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান করা জুবায়ের অনুসারীরা ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কে তাঁদের একটি প্রাইভেট কারে ভাঙচুর চালান। এ সময় প্রাইভেট কারে থাকা সাদ অনুসারীদের পাঁচজন আহত হন।
এ ঘটনার পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
জোড় ইজতেমা আয়োজন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকেই তুরাগ নদের পাড়ে টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা জামে মসজিদে জড়ো হতে থাকেন কয়েক হাজার সাদ অনুসারী। বিষয়টি জানতে পেরে গতকাল রাত থেকেই ইজতেমা ময়দানের প্রায় সব প্রবেশপথে জড়ো হয়ে কড়া পাহারা দিতে শুরু করেন জুবায়েরপন্থীরা। আজ ভোরে মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা ইজতেমা ময়দানের কয়েকটি প্রবেশপথ দিয়ে ময়দানে ঢোকার চেষ্টা করেন। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে অন্তত ৪০–৫০ জন আহত হন।
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের রেজিস্ট্রারের তথ্য অনুযায়ী, আজ বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৩৯ জন ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা জ্যেষ্ঠ সেবিকা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভোর সাড়ে ৪টা থেকে আহতরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসতে থাকেন। একজনের মরদেহ হাসপাতালে আছে।’ তবে তিনি তাঁর পরিচয় জানাতে পারেননি।
পরে হাসপাতাল ও তাবলিগের দুই পক্ষের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে চারজন নিহতের তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মাওলানা জুবায়েরের অনুসারী ইজতেমা আয়োজক কমিটির গণমাধ্যম সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, ‘ইজতেমা ময়দানে আমাদের ঘুমন্ত সাথিদের ওপর হামলা করে একজনকে হত্যা করা হয়েছে।’
ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির ইজতেমা আয়োজক কমিটির গণমাধ্যম সমন্বয়ক মুহাম্মদ সায়েমও তাঁদের একজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেন।
অন্যদিকে, ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মো. ফারুক আরেকজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আজ ভোর ৪টার দিকে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপর তাঁদের ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসক একজনকে মৃত ঘোষণা করেন।
কাকরাইল মসজিদ ও ঢামেক এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা মাঠের দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর আহতদের ভর্তি করা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে কাকরাইল মসজিদ ও ঢাকা মেডিকেল এলাকা নিরাপত্তা জোরদার করেছে র্যাব।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে র্যাব-৩।
এতে বলা হয়, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের দখল নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় কাকরাইল মসজিদ ও ঢাকা মেডিকেল এলাকায় র্যাব-৩ এর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এর আগে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা মাঠের দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকায় ৪ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।
উত্তরা ও তুরাগ নদ সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ
টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান দখল নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা সেক্টর-১০ এবং তৎসংলগ্ন তুরাগ নদীর দক্ষিণ পশ্চিম এলাকায় যে কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ ইত্যাদি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী গণমাধ্যমকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ডিএমপি কমিশনার স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, সম্প্রতি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্সের ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে ১৮ ডিসেম্বর বুধবার বেলা ২টা থেকে কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা সেক্টর-১০ এবং তৎসংলগ্ন তুরাগ নদীর দক্ষিণ পশ্চিম এলাকায় যে কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ ইত্যাদি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হলো।
‘ইজতেমা মাঠে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না‘
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার মাঠ নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে হতাহতের ঘটনায় জড়িতদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। এতে ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। খুনিদের কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়ার সুযোগ নাই। যারা প্রকৃত দোষী তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ মাওলানা জুবায়েরপন্থী ও সাদপন্থীদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
উপদেষ্টা বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অন্যায়কারীকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সঠিক তদন্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপকে অনমনীয় অবস্থান থেকে সরে এসে ছাড় দিতে হবে। তবেই আমরা একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল বিশ্ব ইজতেমা উপহার দিতে পারব।
উপদেষ্টা এসময় বিশ্ব ইজতেমার মাঠে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নিহত শহিদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ সহকারী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হাফিজ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী প্রমুখ।