খেলাপি ঋণ বেড়ে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■ 

গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ওই সময়ের মোট ঋণের যা ৯ শতাংশ।

অর্থাৎ, এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা।

বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এ সময় ডেপুটি গভর্নরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

গভর্নর বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আগামীতে হয়তো আরও বাড়বে। তবে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় আমরা সে চেষ্টা করছি। বিভিন্ন আইন কঠোর করার চেষ্টা চলছে।

গত সরকারের আমলে গোপন রাখা খেলাপির সঠিক তথ্য প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ায় বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেরিয়ে এসেছে বলে জানান তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জানান, তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৬.৯৩ শতাংশ। তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ল ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

আহসান এইচ মনসুর জানান, মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ৪২.৮৩ শতাংশ; তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এ হারছিল ৪০.৩৫ শতাংশ।

ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১৫. ৬০ শতাংশ; তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ১১.৬৬ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।

গভর্নর বলেন, খেলাপি ঋণের এ হার প্রত্যাশিত। আগের সরকারের সময়ে খেলাপি ঋণ গোপন করে রাখার কারণে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ।  যত সময় যাচ্ছে, ঋণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে, এতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়ছে।

তথ্য অনুযায়ী, তিন মাসে (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর প্রান্তিক) খেলাপি ঋণ ৬০ লাখ ৭৮৭.৫৫ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে। এর আগে গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ শতাংশ। সেই হিসেবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ দশমিক ২০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ছিল ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকে ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ছিল ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হারও নির্ধারিত মাত্রার অনেক উপরে।

এ বিষয়ে ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, এখন খেলাপি ঋণ কমানোর প্রকৃত সময়। এজন্য ঋণ আদায়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আদায় ছাড়া কোনোভাবেই খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হবে না।

অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের এতদিন যারা ডেকে রেখেছেন, তাদের ছাড়া দেওয়া ঠিক হবে না; পাশাপাশি যারা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না, তাদেরও ধরতে হবে।

খেলাপিদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে জানিয়ে ড. মইনুল বলেন, ঋণ আদায়ের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, সম্পত্তি জব্দ করে প্রয়োজনে তাদের জেলে পাঠাতে হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করে দ্রুত মামলার নিস্পত্তি করতে হবে। জামিন অবশ্যই ঋণের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে খেলাপি কমে যাবে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলমসহ আরও কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *