:: নাগরিক প্রতিবেদক ::
ঋণখেলাপিবান্ধব বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সুবিধা দিল ঋণখেলাপীদের। এবার ঋণখেলাপিদের জন্য ‘এক্সিট সুবিধার’ ঘোষণা দেওয়া হলো।
এ সুবিধা নিতে খেলাপি ঋণের ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে পরবর্তী দুই বছরে আরও এক বা একাধিক কিস্তিতে পুরো ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ থাকবে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চাইলে আরও এক বছর বেশি সময় পাবেন আবেদনকারী। এক্সিট সুবিধা গ্রহণকারী বিশেষ বিবেচনায় চূড়ান্তভাবে সুদ মওকুফও পেতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি) থেকে এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশনা ব্যাংকগুলোকে পাঠানো হয়েছে। গ্রাহকের কাছে আটকে পড়া ঋণ আদায়ের মাধ্যমে ব্যাংকের তারল্যপ্রবাহ অব্যাহত রাখা এবং ব্যাংকিং খাতে শ্রেণীকৃত ঋণ হ্রাসকল্পে এ নীতিমালা জারি করা হলো বলে বিআরপিডির নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
এ নির্দেশনায় আরও বলা হয়, ঋণগ্রহীতার ব্যবসা, শিল্প বা প্রকল্প কখনো কখনো বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে বন্ধ হয়ে যায় অথবা লোকসানে পরিচালিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা থেকে গ্রাহকের নগদ প্রবাহ বন্ধ বা অপর্যাপ্ত হলে ব্যাংকের ঋণ আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। ওই ধরনের ঋণ বিরূপ মানে শ্রেণীকৃত হয়ে যায়, যা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি পর্যায়ে পড়ে না। নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে গ্রাহকের আর্থিক অবস্থা মন্দ হয়ে পড়ায় ব্যাংকের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়। এ ক্ষেত্রে ‘এক্সিট’ সুবিধাসংক্রান্ত নীতিমালা না থাকায় ব্যাংকগুলো গ্রাহকের এককালীন এক্সিটের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি বা মানদণ্ড অনুসরণ করছে। এমতাবস্থায় একটি অভিন্ন নীতিমালা জারি করা হলো।
এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঋণস্থিতির ন্যূনতম ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নগদে পরিশোধপূর্বক এক্সিট সুবিধা পাওয়ার আবেদন করতে হবে। ঋণগ্রহীতার আবেদন প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেবে ব্যাংক। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা নির্বাহী কমিটি কর্তৃক এক্সিট সুবিধা অনুমোদিত হতে হবে। তবে মূল ঋণ অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত এক্সিট সুবিধা দিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর অর্পণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে পর্ষদ বা নির্বাহী কমিটির অনুমোদন লাগবে না।
এ সুবিধার আওতায় সুদ মওকুফ পাবেন গ্রাহক। তবে এ ক্ষেত্রে বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৬ তারিখ: ২১ এপ্রিল ২০২২, বিআরপিডি সার্কুলার লেটার নং-১৮ তারিখ: ২৪ মে ২০২২ এবং পরবর্তী সময়ে জারি করা সাকুলার/সার্কুলার লেটারের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। মওকুফযোগ্য সুদ পৃথক ব্লকড হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে এবং সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের পর ব্লকড হিসাবে রক্ষিত সুদ চূড়ান্ত মওকুফ হিসেবে গণ্য হবে।
এক্সিট সুবিধার আওতায় এক বা একাধিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করা যাবে। একাধিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিশোধসূচি প্রণয়ন করতে হবে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সাধারণভাবে দুই বছরের অধিক হবে না। তবে পরিচালনা পর্ষদ যুক্তিসংগত কারণ বিবেচনায় সর্বোচ্চ আরও এক বছর সময় বৃদ্ধি করতে পারবে।
এক্সিট সুবিধা গ্রহণকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানিকে ওই ঋণ সম্পূর্ণ পরিশোধ বা সমন্বয়ের আগ পর্যন্ত কোনোরূপ নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়া যাবে না। এক্সিট সুবিধার আওতায় অবলোপন করা ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে বিআরপিডি সার্কুলার নং-০৪/২০২৪-এর নির্দেশনা অনুসরণীয় হবে।
ঋণের বিপরীতে যথানিয়মে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে এবং ঋণ সমন্বয়ের আগে ঋণের বিপরীতে গৃহীত জামানত অবমুক্ত করা যাবে না। তবে ব্যাংক, গ্রাহক ও ক্রেতা আগ্রহী হলে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে আলোচ্য ঋণের বিপরীতে বন্ধক সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে ঋণ সমন্বয় করা যাবে। এক্সিট সুবিধা পাওয়ার পর গ্রাহক পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণ আদায়ে ব্যাংক প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোও এই নীতিমালা অনুসরণ করে তাদের নিয়মিত ও বিরূপ মানে শ্রেণীকৃত বিনিয়োগ আদায় বা সমন্বয়ের ব্যবস্থা নিতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২৪ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.১১ শতাংশ। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫০ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা এবং তিন মাসে বেড়েছে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এক বছর আগে ২০২৩ সালের মার্চে ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ হাজার কোটি টাকা এবং গত ডিসেম্বরে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে ২০১৯ সালের মে মাসে একবার ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক্সিটের জন্য বিশেষ নীতিমালা জারি করেছিল। এতে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ এবং স্থগিত সুদ মওকুফের বিধান যুক্ত করা হয়। ওই সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এক হাজার ৩২২ কোটি টাকার এক্সিট সুবিধার বিপরীতে সুদ মওকুফ হয় এক হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক্সিটের ২৯৫ কোটি টাকা বেশি সুদ মওকুফ হয়। নতুন করে এমন এক সময়ে এক্সিটের নীতিমালা করা হলো যখন আইএমএফের শর্ত মেনে খেলাপি ঋণ কমানোর পরিবর্তে উল্টো বাড়ছে। গত মার্চ শেষে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ ঠেকেছে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়। ওই সময় পর্যন্ত তা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। ব্যাংক খাতে এখন প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার মতো ঋণ অনাদায়ী রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ রকম সুবিধা ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানোর স্থায়ী কোনো সমাধান না। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কঠোর হতে হবে। অনাদায়ী ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন করে মামলা করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এ রকম না হয় সে জন্য ঋণ বিতরণের সময় যথাযথ ব্যক্তিকে দিতে হবে। এ জন্য পরিচালনা পর্ষদকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তা না করে শর্ষের মধ্যে ভূত রেখে সমস্যার সমাধান হবে না । খেলাপি ঋণ কমাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুশাসন নিশ্চিত করা। এ জন্য প্রয়োজনে কিছু পরিচালককে জেলে দিতে হবে। যারা অনিয়মে জড়িত মালিকানায় থাকলেও তারা যেন পর্ষদে থাকতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকেই ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যেতে চান। তবে কোনো নীতিমালা না থাকায় তাঁরা ব্যাংকঋণ শোধ করতে সমস্যায় পড়েন। অনেক সময় ব্যাংকগুলো একেবারে পুরো অর্থ শোধ দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। এতে অনেকেই ঋণ থেকে বেরিয়ে যেতে সমস্যায় পড়েন। নতুন নীতিমালার ফলে ব্যাংকগুলো সুবিধা পাবে এবং ব্যবসায়ীরাও সুবিধামতো ঋণ শোধ করে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারবেন।