■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪৪৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর এ সময়ের মধ্যে মারা গেছেন ৩ জন। এর ফলে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১০১ জনের।
রোববার (১০ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য থেকে এসব জানা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়েছে, চলতি জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪,১৮৩ জন। মারা গেছেন ৪১ জন। আগস্টে এখন পর্যন্ত ৩,২০৩ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১,৩৭৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩৮৯ জন, বাকি ৯৮৫ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগের।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৮১ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৮৪ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩৪ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৪৮ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) আটজন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩৪ জন, রংপুর বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) সাতজন, সিলেট বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) দুজন রয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ৪০৪ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরের এ যাবত ২২ হাজার ৭০৮ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি ১০,৬৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ৯ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২,৭৫৫ জন রোগী। জুন মাসে ৫,৯৫১ জন, জানুয়ারিতে ১,১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন এবং মে মাসে ১,৭৭৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ডেঙ্গুতে প্রাণহানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে জুলাই মাসে। অগাস্টের প্রথম নয় দিনে ১৫ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এছাড়া জুন মাসে ১৯ জন, জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে সাতজন, মে মাসে তিনজন মারা যান। মার্চ মাসে কেউ মারা যায়নি।
চলতি বছরের ১০ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ২৪ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে ৫৮ দশমিক সাত শতাংশ পুরুষ ও ৪১ দশমিক তিন শতাংশ নারী রয়েছেন।
২০২৪ সালের আগস্টের ১০ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১০২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এবার ডেঙ্গু বেশি ছড়িয়েছে রাজধানীর বাইরে। সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় কোনো কার্যক্রম নেই। আবার স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের অভাব একটা বড় সমস্যা। সরকার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলছে। কিন্তু সেটা ডেঙ্গুকে দিয়েই শুরু করা উচিত। ডেঙ্গু পরীক্ষা থেকে স্বাস্থ্যসুবিধা মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। এর কোনো প্রচেষ্টা দেখি না।
গত দুই দশকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জুলাইয়ের শেষে কিংবা আগস্টের শুরু থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তবে এ বছর জুনের শুরুতেই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। বাইরে থেকে বেশি আসছে সংকটাপন্ন রোগী। বরিশাল ও বরগুনায় রোগীর বিপরীতে পর্যাপ্ত শয্যা সংকটের কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। রোগীদের অভিযোগ, স্যালাইন ও ওষুধের সংকট রয়েছে। প্লাটিলেট সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, মশক নিধন কার্যক্রম প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি। এ জন্য ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। একা কোনো সংস্থার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভাইরাসটি প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে কর্মসূচি নেওয়া দরকার। তবে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ টিম কাজ করছে বলে জানান তিনি।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে একলাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৭৫ জন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭০৫ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৮৬৮ জনের। এ সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৮ জন। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা গিয়েছিল, শুধু ২০২৩ সালেই তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ রোগে।
দেশের প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়।
২০০০ সালের পরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু ধীরে ধীরে কমে এলেও ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করে দেশ। ২০১৯ সালে ১ লাখেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
২০২০ সালে করোনার প্রকোপের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল। ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৭ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন এবং ২০২২ সালে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়।
ঢাকার তুলনায় এর বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০২৩ সালে ছিল দ্বিগুণের বেশি। সারা দেশের মৃত্যুর ৫৮ শতাংশই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের।