২৩ বিষয় নিয়ে শুরু হচ্ছে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাত সরকারি কলেজকে নিয়ে যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র। প্রথমে ৪টি অনুষদে ২৩টি বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তোলা হবে ধাপে ধাপে।

চলতি মাসের শেষে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর ধারাবাহিকতায় দ্রুততম সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য (ভিসি), দুজন উপ-উপাচার্য (প্রো-ভিসি) ও একজন কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) নিয়োগ এবং একজন প্রক্টর ও ১৪ ডেপুটি প্রক্টরসহ ১৫ সদস্যের প্রক্টরিয়াল বডি গঠন করা হবে। বর্তমানে জাতীয় সংসদ না থাকায় এ-সংক্রান্ত আইন পাসের সুযোগ নেই, তাই আপাতত অধ্যাদেশের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সম্মতি দেবেন রাষ্ট্রপতি।

নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবেন একজন উপাচার্য, দুজন উপ-উপাচার্য (একাডেমিক ও প্রশাসনিক), একজন ট্রেজারার এবং একজন প্রক্টর। সাত কলেজের প্রতিটিতে একজন পুরুষ ও একজন নারী করে মোট ১৪ জন ডেপুটি প্রক্টর দায়িত্ব পালন করবেন। শিক্ষা হবে ইন্টারডিসিপ্লিনারি (একাধিক শাখার মধ্যে সমন্বয়) ও হাইব্রিড (অনলাইন ও অফলাইন দুটি পদ্ধতিকে এক করে সমন্বয়) ধাঁচের। যেখানে ৪০ শতাংশ ক্লাস অনলাইন এবং বাকি ৬০ শতাংশ হবে অফলাইনে। তবে সব পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে সশরীরে। শিক্ষার্থীরা প্রথম চার সেমিস্টারে নন-মেজর কোর্স এবং পরবর্তী চার সেমিস্টারে পড়বেন মেজর কোর্স।

পঞ্চম সেমিস্টারে শর্তসাপেক্ষে ডিসিপ্লিন পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও কলেজ পরিবর্তন করা যাবে না। বর্তমানে বিভিন্ন বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা আগের নিয়মেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করবেন। তবে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ এবং এর পর ভর্তি হওয়া সব শিক্ষার্থী নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ (সার্টিফিকেট) পাবেন।

২০১৭ সালে কোনো আইনি ও প্রশাসনিক পদ্ধতি অনুসরণ না করেই রাজধানীর সরকারি সাতটি বড় কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই সেশনজট, পরীক্ষার ফল প্রকাশে বিলম্ব, শিক্ষক ও অবকাঠামো সংকট, সার্টিফিকেট পেতে বিড়ম্বনাসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে অধিভুক্তি বাতিল করে স্বতন্ত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে দফায় দফায় আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। অসংখ্যবার সড়ক অবরোধ করে সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশের সঙ্গে। এরপর সাত কলেজের সমস্যা চিহ্নিত করতে একটি পর্যালোচনা কমিটি করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই কমিটির সুপারিশের পর আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের জন্য ইউজিসির নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের আরেকটি কমিটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে সাত কলেজের ঢাবির অধিভুক্তি বাতিল এবং স্বতন্ত্র ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় করার সুপারিশ করে গত ডিসেম্বর মাসে। ওই সুপারিশ জমার পর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও কাঠামোগত দিক চূড়ান্তে একাধিক বৈঠক করে এ-সংক্রান্ত কমিটি। আজ সোমবার শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার একটি সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানাবেন।

শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চারটি প্রধান স্কুল বা অনুষদে ভাগ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে স্কুল অব সায়েন্স পরিচালিত হবে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ এবং বেগম বদরুন্নেসা কলেজ থেকে। স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ সরকারি বাঙলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজে পরিচালিত হবে স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজ। স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিস কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে পরিচালিত হবে। স্নাতক পর্যায়ে মোট ২৩টি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হবে। যেখানে প্রতিটি ডিসিপ্লিনে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবেন। মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজে প্রায় ২৫ একর জমি অব্যবহৃত রয়েছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস, প্রশাসনিক ভবন, লাইব্রেরি, মেডিকেল সেন্টার এবং ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) স্থাপন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে একাডেমিক কাউন্সিল, সিনেট ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। কলেজগুলো শুধু স্নাতক (অনার্স) পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করবে। বিশ্ববিদ্যালয় হলেও সাত কলেজের পাঁচটিতে আগের মতোই একাদশ পর্যায় চালু হবে। বাকি দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইডেন এবং কবি নজরুল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় চালু করতে হবে। স্নাতক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা টাইম, স্পেস ও রিসোর্স শেয়ারিং পদ্ধতিতে একই ক্যাম্পাস ব্যবহার করতে পারবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জনবল ও বাজেট ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে। কলেজগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়োগকৃতদের বণ্টন করতে পারবে। বাজেট গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনা হবে কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। প্রতিটি কলেজে ওয়ানস্টপ সার্ভিস পয়েন্ট থাকবে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা যে কোনো প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। প্রতিটি কলেজে থাকবে আধুনিক মানসম্পন্ন লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া ও মেডিকেল সেন্টার। এ ছাড়াও প্রতিটি কলেজেই পরিবহন ব্যবস্থা থাকবে।

যেসব বিষয়ে করা যাবে স্নাতক:

ঢাকা কলেজে পড়ানো হবে গণিত, পরিসংখ্যান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, ডাটা সায়েন্স, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োটেকনোলজি ও রসায়নসহ ৭টি বিষয়।

ইডেন কলেজে থাকবে পদার্থবিজ্ঞান, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, ফরেস্ট্রি সায়েন্সসহ ৫টি বিষয়।

বদরুন্নেসা কলেজে ২টি বিষয়—আরবান অ্যান্ড রুরাল প্ল্যানিং এবং এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়ার সুযোগ থাকছে।

সরকারি তিতুমীর কলেজে পড়ার সুযোগ থাকছে অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, হোটেল অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস এবং ব্যাংক অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স ম্যানেজমেন্টসহ ৬টি বিষয়ে।

সরকারি বাঙলা কলেজে জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন স্টাডিজ, ফটো অ্যান্ড ভিডিওগ্রাফি, অ্যাপ্লাইড সোশিওলজি, পলিটিক্যাল ইকোনমি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, অর্থনীতি এবং ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স অ্যান্ড ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজসহ ৬টি বিষয় পড়ানো হবে।

কবি নজরুল কলেজ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ যৌথভাবে ‘ল অ্যান্ড জাস্টিস’-এর একটি বিভাগে পাঠদান চলবে।

ভর্তি হতে পারবেন যারা:

বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তি প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হবে। যারা ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের এসএসসি এবং ২০২৩ বা ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তারা আবেদনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। গত ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের জন্য যারা আবেদন করেছিলেন, তাদের নতুন করে আবেদন করার প্রয়োজন নেই। তবে যারা আবেদন প্রত্যাহার করতে চান, তারা ৩ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত আবেদন প্রত্যাহার করতে পারবেন এবং তাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। নতুন করে ৩ আগস্ট থেকে আগামী ১০ আগস্ট পর্যন্ত অনলাইনে আবেদন নেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা collegeadmission.eis.du.ac.bd ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন করতে পারবেন। আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০০ টাকা। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের যে কোনো শাখায় অথবা অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে এ ফি জমা দেওয়া যাবে।

কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হবে ২২ আগস্ট (শুক্রবার) বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। এমসিকিউ পদ্ধতির ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান—তিন বিষয়ে ১০০টি প্রশ্ন থাকবে। প্রতিটি ভুল উত্তরে ০.২৫ নম্বর কাটা যাবে। আর পাস নম্বর ৪০। বাংলা বা ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুকদের ওই বিষয়েই অন্তত ১০ নম্বর পেতে হবে।

আর বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হবে ২৩ আগস্ট (শনিবার) বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। ভর্তি পরীক্ষা এমসিকিউ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ২০২৪ সনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুসৃত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী হবে এবং প্রত্যেক প্রার্থীকে পদার্থ ও রসায়নসহ মোট চারটি বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রতি বিষয়ের জন্য মোট নম্বর ২৫। আর ১০০টি প্রশ্নের জন্য মোট নম্বর হবে ১০০। ভর্তি পরীক্ষায় পাশ নম্বর ন্যূনতম ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ ৪০ নম্বরের কম পেলে কেউ ভর্তি হতে পারবেন না। 

এছাড়া বাণিজ্য ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাও ওই একইদিন বিকেল ৩টা থেকে ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে। 

অন্যদিকে, ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আবেদন ফি ধরা হয়েছে ৮০০ টাকা। সোনালী, জনতা, রূপালী ও অগ্রণী ব্যাংকের যেকোনো শাখা কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ও বিকাশ, নগদ এবং রকেটের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে। আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে প্রবেশপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সঙ্গে রাখতে হবে।

ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মেধাক্রম তৈরি হবে মোট ১২০ নম্বরের ওপর— এসএসসির ১০ নম্বর, এইচএসসি ১০ নম্বর এবং পরীক্ষার ১০০ নম্বর যোগ করে। কলেজ ও বিষয় পছন্দক্রম অনলাইনে দিতে হবে, আর ২০ অক্টোবর বিষয় বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হবে। ভর্তি শেষ তারিখ ২৫ অক্টোবর এবং ক্লাস শুরু হবে ৩০ অক্টোবর।

একইসঙ্গে কোটায় ভর্তি-ইচ্ছুদের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, উপজাতি, প্রতিবন্ধী, হরিজন-দলিত, ক্রীড়াবিদ, ওয়ার্ড এবং হিজড়া) অবশ্যই ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর পেতে হবে এবং সাত দিনের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিসে প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে বলেও জানানো হয়েছে। 

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজ—ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রমে নতুন গতি আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও সাত কলেজের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, ‘যেহেতু শিক্ষা উপদেষ্টা কথা বলবেন (আজকের ব্রিফিং) তাই আমি বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। তবে আমাদের প্রস্তাব ছিল যাই করা হোক না কেন, কলেজগুলোর যেন স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে। যেমন ঢাকা কলেজ ছেলেদের ও ইডেন-বদরুন্নেসা মেয়েদের। এসব যেন মিক্সড (মিশ্র) না হয়।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *