:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
হামলাকারীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের আশ্বাসে আগামীকাল সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত কর্মবিরতি কর্মসূচি স্থগিত করেছেন চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে আলোচনার পর রোববার (১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা এ ঘোষণা দেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, ক্যাজুয়ালিটি এবং নিউরো সার্জারিতে চিকিৎসাসহ অন্যান্য চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান।
রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার দিকে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান তিনি।
তিনি বলেন, কর্মরত চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
এদিকে হামলার ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
এর আগে দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম হামলার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার অঙ্গীকার করে চিকিৎসকদের দেওয়া কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান। পরে পৌনে চারটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি পরিচালকের কক্ষে চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়কও তাতে যোগ দেন।
বৈঠকে উপদেষ্টা বলেন, যে কোনো জায়গায় কিছু হলেই চিকিৎসকদের ওপর হামলা হয়। এটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগে। আপনাদের কথা শুনতে এসেছি। আমিও সমব্যথী। আমি আপনাদের মায়ের মতো, মায়ের কাছে কিছু লুকাতে নেই। আপনারা বলেন, আমি স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার করতে চাই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানের কক্ষে এই বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহও অংশ নেন।
শনিবার বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির (বিইউবিটি) শিক্ষার্থী আহসানুল হক দীপ্তর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সূত্রপাত হয় ঘটনার।
অবহেলায় তার মৃত্যু হয় অভিযোগ তুলে দীপ্তর ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা ঢামেকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে চিকিৎসকদের মারধর করেন। এ সময় আহত হন নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ইমরান, মাশরাফি ও জুবায়ের।
এ ঘটনায় হামলাকারীদের গ্রেফতার এবং নিরাপত্তার দাবিতে কর্মবিরতিতে যান ঢাকা মেডিক্যালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। একই দাবিতে সারাদেশে চিকিৎসা না দিতে কমপ্লিট কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণাও দেন তারা।
চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে দুর্ভোগে পড়েন শত শত রোগী।
এর আগে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভাঙচুর ও চিকিৎসকদের মারধরের ঘটনায় এ ঘোষণা দেন ঢামেকের নিউরো সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন আব্দুল আহাদ।
ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি বলেন, শনিবার হাসপাতালের পরিচালকের অনুরোধে রাত ১১টায় কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাই। আমরা সকাল ৮টা পর্যন্ত ইমার্জেন্সি সার্ভিস দিয়েছি। হাসপাতালে আমরা ছিলাম। কিন্তু আমরা কোনো নিরাপত্তা ফোর্স এখানে দেখি নাই। ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্সের সামনে নিরাপত্তা ফোর্স থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমরা দেখি নাই। তাই আমরা বাধ্য হয়ে নিরাপত্তার জন্য আজ থেকে সারা দেশে কর্মবিরতিতে যাচ্ছি।
হামলাকারীদের আটক ও শাস্তির পাশাপাশি সারা দেশে চিকিৎসক ও রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ দুই দফা দাবি জানানো হয় চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে। কিন্তু দাবি পূরণের আশ্বাস না মেলায় দুপুরে সারা দেশে সব চিকিৎসাকেন্দ্রে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করে ৬ দফা দাবি জানানো হয়।
সারা দেশের সব হাসপাতালে চিকিৎসক ও রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্বতন্ত্র স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগের দাবি জানান ডা. আব্দুল আহাদ বলেন। রোববার দুপুর ২টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন ঢামেকের নিউরো সার্জারি বিভাগের ডা. আব্দুল আহাদ।
আব্দুল আহাদ বলেন, প্রথম ঘটনা আমাদের নিউরো সার্জারি বিভাগে। একজন আবাসিক ডাক্তার অপারেশন করার জন্য অপারেশন থিয়েটারে যায়। রোগীর লোক তাকে বের করে তার উপর ধস্তাধস্তি করে, ডাক্তারকে মারে। তাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের আরেক ডাক্তার ওখানে যান, তখন তার ওপরও অতর্কিতে আক্রমণ করে। কলার ধরে তাকে ২০১ নম্বর অপারেশন থিয়েটারের সামনে থেকে পরিচালকের সামনে নিয়ে আসে।
তিনি বলেন, আমরা এ নিয়ে বৈঠকে বসেছিলাম, দুইটা সিদ্ধান্ত, আমাদের চিকিৎসকদের ওপর যারা আক্রমণ করেছে, অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করতে হবে এবং আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যারা ইমার্জেন্সি সার্ভিস দিই, আপনারা দেখেছেন, সেখানে কত লোক থাকে। ইমার্জেন্সি সার্ভিস দেওয়ার জন্য আমাদের যথেষ্ট আর্মি পুলিশ এবং অন্যান্য ফোর্স এখানে থাকবে। সশরীরে উইথ আর্মস সেখানে উপস্থিত থাকবে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল প্রশাসন এটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই চিকিৎসক বলেন, কালকে রাতে আরও দুটি ঘটনা ঘটে, একটা ঘটনা হচ্ছে, একটি গ্রুপ বাইরে আরেকটা গ্রুপকে আক্রমণ করেছিল। সেই গ্রুপ সেবা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে এসেছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে এসেছিল চিকিৎসা সেবা নিতে, তাদের যে বিরোধী পক্ষ ছিল, তারা ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে চলে গেছে। তাই, আমরা দেখছি এখানে রোগীও নিরাপদ না। আপনারা কোথায় সেবা নিতে আসবেন। এখানে রোগীও নিরাপদ না।
তিনি বলেন, আরেকটা ঘটনা, ইমার্জেন্সি রুমে একজন কিডনি রোগী এসেছিল, অনেক ইমার্জেন্সি রোগী মারা যায়। মারা যাওয়ার পরে ডক্টর ও মেডিকেল অফিসারের উপর হামলা হয়। ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্স ওসেক ভাঙচুর করা হয়। তাই আমরা দেখতে পাই এখানে ডক্টর রোগী কেউই নিরাপদ না।
এর আগে চিকিৎসকদের ওপর হামলার বিচার ও নিরাপত্তার দাবিতে রোববার সকালে ইন্টার্নি চিকিৎসক এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সব চিকিৎসক কর্মবিরতি শুরু করেন। এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন, ঢামেকের নার্স ও কর্মচারীরা। নার্সদের পক্ষ থেকে জামাল উদ্দিন বাদশা বলেন, আমরা চিকিৎসকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। আমাদের দাবি, সকল কর্মস্থলে নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
কর্মবিরতির কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে অনেক রোগীকে। সকাল থেকে দূর দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা জরুরি বিভাগে দুর্ভোগে পড়তে দেখা গেছে।
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের চার দফা দাবি হলো—
১. ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলায় অপরাধীদের গ্রেফতার ও বিচার।
২. ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা মেডিক্যালসহ দেশের সব জেলা উপজেলা ও বিভাগীয় হাসপাতালে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও অস্ত্র হাতে সার্বক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী রাখতে হবে।
৩. ভবিষ্যতে চিকিৎসক ও হাসপাতালের নিরাপত্তা দিতে ৭ দিনের মধ্যে স্বতন্ত্র স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে।
৪. দ্রুত স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।