■ ঢাবি প্রতিনিধি ■
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত পৌনে নয়টা পর্যন্ত সিন্ডিকেটের জরুরি সভা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয় সংলগ্ন লাউঞ্জে এ সভা হয়। সভায় সিন্ডিকেটের ১৭ সদস্যের মধ্যে ১৫ জন অংশ নেন।
সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনীতি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা যে ৯ দফা দাবি দিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি বন্ধ চেয়ে বিক্ষোভ–মিছিল ও সমাবেশ করেছেন একদল শিক্ষার্থী।
গতকাল (বুধবার) রাত ৮টার দিকে চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে আটকে রেখে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার করে একদল শিক্ষার্থী। গতকাল বুধবার রাতে কয়েক ঘণ্টা ধরে দফায় দফায় মারধরে ওই যুবকের মৃত্যু হয়। গতকাল দিবাগত রাত ১২টার দিকে কয়েকজন শিক্ষার্থী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাত ২টার দিকে তার মৃত্যুর খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তোফাজ্জল পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে এবং ওই ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স–মাস্টার্স শেষ করে বঙ্গবন্ধু ল কলেজে ভর্তি হন। পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুতে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।
গতকাল বুধবার রাতে চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেস্টরুমে তোফাজ্জলকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেন একদল শিক্ষার্থী। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
চাচা ফজলুর রহমান বলেন, ‘তোফাজ্জলের বাবা আব্দুর রহমান প্রায় ১০ বছর আগে মারা যায়, এর তিন বছর পরে মারা যায় তার মা। এর পর থেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সে। বড় ভাই নাসিরের আশ্রয়ে থাকতে শুরু করে। ভাইও দুই বছরে আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
‘এরপরেই অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ে সে। বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করে সে। ভাই মারা যাওয়ার কিছুদিন পরে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে মারধর করে বাজারের লোকজন। এরপরেই সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তোফাজ্জেল মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও কাউকে মারধর বা কিছুই করত না। সে শুধু পরিচিত লোকজনের সঙ্গে দেখা হলেই ২০ টাকা, ৫০ টাকা বা ১০০ টাকা চেয়ে নিত। কোনো কিছুতেই এর বেশি তার চাহিদা ছিল না। পাথরঘাটার এক লোক তাকে আশ্রয় দিয়ে চিকিৎসাও করেছিলেন। সেখানে থেকে কিছুটা সুস্থ হয়েছিল সে। এরপরে শুনেছি ঢাকায় চলে গেছে।
‘ঢাকায় তাকে চুরির অপবাদ দেওয়া হয়েছে এটা মানার মতো না, আমি কখনোই তাকে চুরি করতে দেখি নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চুরি অপবাদ দেওয়া হয়েছে—এটার কোনো সত্যতা পাইনি।’ প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টি তদন্ত করে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।
নিহতের চাচাতো ভাই ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমরা আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে শুনেছি তোফাজ্জলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এখন ঢাকা মেডিকেলে ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে আছেন চাচাতো ভাই শাহাদাত হোসেন। থানার আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হবেন। মরদেহ আনার পর জানাজা শেষে বাবা–মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে।’
তোফাজ্জলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী শরীফা আক্তার বলেন, ‘ভোরে অপরিচিত একটি ফোন নম্বর থেকে কল আসে। ফোনটা ধরার পরেই অপর প্রান্ত থেকে এক লোক তোফাজ্জল কী হয় সে কথা জানতে চায়। সে দেবর—এ কথা বলার পরেই তিনি বলেন, সে চুরি করে ধরা পড়েছে, তাকে বাঁচাতে হলে দুই লাখ টাকা দিতে হবে। এরপর তারা ফোনে ধমক দিতে থাকেন এবং বলেন, কোন মিথ্যা কথা বলবেন না, তাহলে সমস্যা হবে।
‘তাদের সঙ্গে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পরে বিভিন্ন লোকজনে ফোন দিয়ে জানান, তোফাজ্জল মারা গেছেন। আমার স্বামীর বংশ পরিচয় দেওয়ার মতো আর কিছুই রইল না। আমার দুই ছেলে, তারা বাবা হারা, তাদের একজন চাচা ছিল তা–ও শেষ করে দিল। আমরা আল্লার কাছে বিচার দিলাম, যারা এ কাজ যারা করেছে তাদের যেন বিচার করেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাথরঘাটা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আল মামুন বলেন, ‘আমাকে ঢাকা থেকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এর পরে আমি নাম–ঠিকানা যাচাই করে জানতে পেরেছি, তার বাড়ি কাঠালতলী এলাকার তালুক চরদুয়ানী গ্রামে তার বাড়ি। সে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। তার পরিবারকে সংবাদ দিয়েছি। তারা ঢাকাতে যোগাযোগ করেছেন। সেখান থেকে তারা লাশ নিয়ে আসবেন। লাশের আইনি প্রক্রিয়া সেখান থেকেই শেষ করে পাঠাবেন তারা।’
একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপসম্পাদক জালাল মিয়াসহ হলের ৮-১০ জন শিক্ষার্থী তোফাজ্জলকে মারধর করছেন।
ভোর সাড়ে ৪টায় প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান। সেখান থেকে পরে হল প্রাঙ্গণে এসে হলের পুরাতন ভবনের গেস্টরুম ও এক্সেটেনশনের গেস্টরুম ঘুরে দেখেন। এই দুটি গেস্টরুমেই তোফাজ্জলকে মারা হয়। এসময় তিনি দুটি রুম সিলগালা করে দেন।
এদিকে এ ঘটনায় মোট ৬ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ। তারা হলেন- পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী জালাল মিয়া, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মুত্তাকীন সাকিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আল হোসেন সাজ্জাদ, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ ও ওয়াজিবুল আলম। তারা সবাই এফএইচ হলের আবাসিক ছাত্র। তাদের মধ্যে জালাল মিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপসম্পাদক। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে তিনি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগে করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন। অপর ৫ জনের রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়নি।