■ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছে ছাত্রশিবিরের সাদিক কায়েম এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে বিজয়ী হয়েছে এস এম ফরহাদ।
বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে ঘোষিত চূড়ান্ত ফলাফল থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ভিপি পদে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়েছেন সাদিক কায়েম। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৫ হাজার ৭০৮ ভোট।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভিপি, জিএস ও এজিএস এবং ১২টি সম্পাদক পদের মধ্যে ৯টিতে জয় পেয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর প্রার্থীরা।
স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের উমামা ফাতেমা পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৮৯ ভোট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের আবদুল কাদের ১ হাজার ১০৩ ভোট এবং প্রতিরোধ পর্ষদের তাসনিম আফরোজ ইমি পেয়েছেন ৬৮ ভোট।
জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে বিজয়ী ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারি হামিম পেয়েছেন ৫ হাজার ২৮৩ ভোট। এরপর প্রতিরোধ পর্ষদের প্রার্থী ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মেঘমল্লার বসু পেয়েছেন ৪ হাজার ৯৪৯ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরী ৪ হাজার ৪৪ ভোট এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের আবু বাকের মজুমদার পেয়েছেন ২ হাজার ১৩১ ভোট।
এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) পদে শিবিরের মুহা. মহিউদ্দীন খান পেয়েছেন ১১ হাজার ৭৭২ ভোট, ছাত্রদলের তানভীর আল হাদী মায়েদ ৫ হাজার ৬৪ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমীদ আল মুদাসসীর পেয়েছেন ৩ হাজার ৮ ভোট। আর প্রতিরোধ পর্ষদের জাবির আহমেদ জুবেল পেয়েছেন ১ হাজার ৫১১ ভোট। এ ছাড়া মহিউদ্দিন রনি ১ হাজার ১৩৭, আশরেফা খাতুন ৯০০, আশিকুর রহমাস জিম ৭৯৬ ও হাসিব আল ইসলাম ৫২০ ভোট পেয়েছেন।
এ ছাড়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ফাতেমা তাসনিম জুমা (১০ হাজার ৬৩১ ভোট), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ইকবাল হায়দার (৭ হাজার ৮৩৩ ভোট), আন্তর্জাতিক সম্পাদক খান জসিম (৯ হাজার ৭০৬ ভোট ), ছাত্র পরিবহন সম্পাদক আসিফ আবদুল্লাহ (৯ হাজার ৬১ ভোট), ক্রীড়া সম্পাদক আরমান হোসাইন (৭ হাজার ২৫৫ ভোট), কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে উম্মে ছালমা (৯ হাজার ৯২০ ভোট), মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক সাখাওয়াত জাকারিয়া (১১ হাজার ৭৪৭), স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে এম এম আল মিনহাজ (৭ হাজার ৩৮ ভোট) এবং ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম (৯ হাজার ৩৪৪ ভোট) বিজয়ী হয়েছেন।
শিবিরের প্যানেলের বাইরে সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবাইর বিন নেছারী (৭ হাজার ৬০৮ ভোট), সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ (৭ হাজার ৭৮২ ভোট) এবং গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বি (১১ হাজার ৭০৮ ভোট) বিজয়ী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ ছিল না। বিভিন্ন আবাসিক হলে শিবির সন্দেহে মারধরের ঘটনা ঘটত প্রায়ই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে ছাত্রশিবির। প্রকাশ্যে আসার এক বছরের মাথায় ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিশাল জয় পেল তারা।
গত বছর শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য কার্যক্রম শুরু করার পর জানা যায়, নেপথ্যে থেকে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন কর্মসূচি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সাদিক কায়েম। তিনি যে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, সেটিও তখন সামনে আসে। এখন অবশ্য তিনি সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রকাশনা সম্পাদক।
ডাকসুর জয়কে ‘জুলাই প্রজন্মের বিজয়’ বললেন নবনির্বাচিত ভিপি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে নির্বাচিত হয়েছেন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী সাদিক কায়েম। তিনি নিজের এই বিজয়কে কোনো ব্যক্তিগত জয় নয়, বরং ‘জুলাই প্রজন্ম’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর সম্মিলিত বিজয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাদিক কায়েম এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে জয় বা পরাজয় বলে কিছু নেই। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়েছে জুলাই প্রজন্ম, বিজয়ী হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে বিজয়ী হয়েছে জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা এবং শহীদদের স্বপ্ন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই সাদিক কায়েম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র ও মুক্তির সংগ্রামে প্রাণ দেওয়া শহীদদের। তিনি বলেন, আমরা স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের সব শহীদকে, যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা আজ বাংলাদেশ পেয়েছি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করছি। একইসঙ্গে আমরা স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ, আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের শহীদদের। বিশেষভাবে স্মরণ করছি শহীদ আবরারকে, যিনি ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেন তাঁদের সবাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার জানিয়ে সাদিক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাদিক কায়েম, এসএম ফরহাদ, মহিউদ্দিন খানসহ আমাদের প্যানেলের ওপর যে আমানত রেখেছে, আমরা সেই আমানতের যথাযথ হক আদায় করব, ইনশাআল্লাহ। স্বপ্নের যে ক্যাম্পাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।
তিনি আরও বলেন, আমি ডাকসুর ভিপি পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই না। আমি চাই শিক্ষার্থীরা আমাকে ভাই, বন্ধু কিংবা ছাত্র হিসেবে দেখুক। আমার ব্যক্তিত্ব, চরিত্র বা আচরণে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ক্যাম্পাসে বা ক্যাম্পাসের বাইরে, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক যেকোনো সমস্যায় আমি পাশে থাকব, ইনশাআল্লাহ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে সাদিক বলেন, আমরা চাই এই বিশ্ববিদ্যালয় হোক একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউট। এখানে প্রথম বর্ষ থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষার্থী একটি উন্নত অ্যাকাডেমিক পরিবেশে পড়াশোনার সুযোগ পাবে। গবেষণার সুযোগ থাকবে, আবাসনের নিশ্চয়তা থাকবে, খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা থাকবে। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস। ধর্ম, মত, পথ নির্বিশেষে সবাই মিলে আমরা একটি মাল্টিকালচারাল পরিবেশ গড়ে তুলব।
ভিপি নির্বাচিত সাদিক কায়েম নারী শিক্ষার্থীদের অবদানকেও বিশেষভাবে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন সফল করার ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। জুলাই বিপ্লবেও আমাদের বোনেরা সাহস জুগিয়েছেন। তাঁদের সেই আত্মত্যাগ ও অংশগ্রহণ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।
সংবাদ সম্মেলনের শেষে তিনি দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করে বলেন, এই বিজয় কোনো আনন্দ নয়, বরং একটি পরীক্ষা। আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে চাই। শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, নিরাপদ ও আধুনিক ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা চাই।
প্রসঙ্গত, এবার ডাকসুতে ২৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৪৭১ জন। আর ১৮টি হল সংসদে নির্বাচন হয়েছে ১৩টি পদে। হল সংসদের ২৩৪টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৩৫ জন।
ডাকসুতে এবার মোট ভোটার ছিল ৩৯ হাজার ৮৭৪। এর মধ্যে পাঁচটি ছাত্রী হলে ১৮ হাজার ৯৫৯ আর ১৩টি ছাত্র হলে ভোটার ২০ হাজার ৯১৫ জন ভোটার ছিল।