জাতিসংঘে গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি দেখালেন এরদোয়ান

■ নিউইয়র্ক প্রতিনিধি ■

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের মঞ্চে গাজার জীবনের নির্মম ছবি তুলে ধরেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। সেখানে দেখা যায়, ক্ষুধার্ত নারীরা হাতে বালতি ও হাঁড়ি নিয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছেন। 

তিনি বলেন, গাজায় যে গণহত্যা চলছে, যেখানে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। তা নির্মমভাবে অব্যাহত আছে। যার সামান্য বিবেকও আছে, সে কখনোই এ হত্যাযজ্ঞকে মেনে নিতে পারে না, আর চুপ করে থাকতে পারে না এমন গণহত্যার মুখে।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, এসব পদক্ষেপ দুই-রাষ্ট্র সমাধানের বাস্তবায়ন দ্রুত করবে।

এরদেয়ান বলেন, ‘শুধু আপনার বিবেককে প্রশ্ন করুন এবং উত্তর দিন…. ২০২৫ সালে এসেও এই বর্বরতার জন্য কি আমাদের কাছে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে?… এই লজ্জাজনক চিত্র ২৩ মাস ধরে গাজায় প্রতিদিনই ঘটছে।’

গাজা যুদ্ধকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার মুহূর্তগুলির মধ্যে একটি বলে অভিহিত করে ক্ষুধার্ত ও অপুষ্ট এক শিশুর ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন তোলেন, ‘কোন মানবিক বিবেক এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে? কে বা নীরব থাকতে পারে? এই সময়ে এসেও আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে শিশুরা অনাহারে এবং ওষুধের অভাবে মারা যাচ্ছে, সেখানে কি আমরা শান্তি ও শান্তি পেতে পারি?’

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভিসা নিষেধাজ্ঞারও সমালোচনা করেন এরদোয়ান। 

তিনি বলেন, ‘আমি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অনুপস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে চাই, তাদের এই বৈশিক সম্মেলনে আসা আটকে দেওয়া হয়েছে যখন এতর পর এক দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটি দুঃখজনক। 

এরদোয়ান আরও বলেন, ‘আমি এই মঞ্চে আমার ৮ কোটি ৬০ লাখ নাগরিকের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের জন্যও যাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা হচ্ছে, আমি সেই সমস্ত দেশকে ধন্যবাদ জানাতে চাই যারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, এবং আমি অন্যান্য সমস্ত দেশকে আহ্বান জানাচ্ছি যারা এখনও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি… তারাও যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পদক্ষেপ নেয়।’ 

বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা নীরব থাকছে, তারা এই বর্বরতার সহযোগী। অত্যাচারিত ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ান, মানবতার পাশে দাঁড়ান। গাজার বর্বরতার ঘটনায় আপনার জনগণ ঘরে বসে কেন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে? সাহস দেখান, এখনই ব্যবস্থা নিন। আমরা আর এই উন্মাদনা চালিয়ে যেতে পারি না। গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি হতে হবে। যারা গণহত্যা করছে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’

তিনি পুনরায় জোর দিয়ে বলেন, এখন গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা প্রয়োজন, মানবিক সহায়তা নির্বিঘ্ন প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং ইসরায়েলকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।

এই সম্মেলনে ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ভাষণে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রসহ একদল দেশের ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেন এরদোয়ান।

মঙ্গলবার তিনি জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের সাধারণ সভায় ভাষণ দেবেন। ভাষণে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বৈশ্বিক শাসন কাঠামো, বিশেষত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।

ভাষণে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের সামনে দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক শ্রোতাদের উদ্দেশে নিজেদের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরবেন।

১৯৫৫ সালে সাধারণ পরিষদের ১০ম অধিবেশন থেকে ব্রাজিল সবসময় প্রথম বক্তা হিসেবে সাধারণ বিতর্কে বক্তব্য দিয়ে আসছে, শুধু ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সাল ব্যতীত। ব্রাজিলের পর স্বাগতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র বক্তব্য রাখবে। প্রথম দিনের চতুর্থ বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখবেন এরদোয়ান।

রোববার নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, এ বছরের সাধারণ পরিষদকে আগের অধিবেশনগুলো থেকে যে দিক দিয়ে আলাদা করে তা হলো—অনেক দেশ এবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেবে।

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে হামাসকে ‘পুরস্কৃত’ করা: ট্রাম্প

জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনের ভাষণে মার্কিন প্রেডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টায় যুক্ত ছিলেন। আলোচনায় অংশ নেওয়া পক্ষগুলোকে ‘অবশ্যই এটি সম্পন্ন করতে হবে’।

তিনি উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কয়েকটি শক্তিশালী দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি হবে হামাসের নৃশংসতার জন্য একটি পুরস্কার।

তিনি আরও বলেন, হামাসের মুক্তিপণের দাবির কাছে নতি স্বীকার না করে যারা শান্তি চায়, তাদের সবার একসঙ্গে একটাই বার্তা দেওয়া উচিত: এখনই জিম্মিদের মুক্তি দাও।

ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই জাতিসংঘের ভবন নিয়ে অভিযোগ করে আসছেন। ২০১২ সালে তিনি বলেছিলেন, মঞ্চের কাছে থাকা ‘সস্তা’ টাইলস তাকে ‘বিরক্ত’ করছে। এক পর্যায়ে তিনি ভবনটি সংস্কারে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন যা জাতিসংঘ প্রত্যাখ্যান করেছিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে জাতিসংঘ ‘জানে না সে কী চায়’।

তার সাম্প্রতিক অভিযোগ ছিল এসকেলেটরে আটকে পড়া নিয়ে যা স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে সংস্থাটির প্রতি তার আরও বড় ধরনের অসন্তোষ রয়েছে। এরপর ট্রাম্প জাতিসংঘের সমালোচনা করে বলেন, তাদের কাছ থেকে তিনি দুইটি জিনিসই পেয়েছেন—একটা খারাপ এসকেলেটর আর একটা নষ্ট টেলিপ্রম্পটার।

ট্রাম্প বলেন, তিনি যেসব যুদ্ধ ‘সমাধান’ করেছেন সেগুলো শেষ করার আলোচনায় জাতিসংঘ তার পাশে ছিল না। তিনি সাধারণ পরিষদকে প্রশ্ন করেন, ‘জাতিসংঘের উদ্দেশ্য কী? এটি তার সম্ভাবনার কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেনি… এটা ফাঁকা বুলি, আর ফাঁকা বুলি দিয়ে যুদ্ধ শেষ হয় না।’

তিনি আরও দাবি করেন, দ্বিতীয় মেয়াদের এখন পর্যন্ত সাতটি যুদ্ধ তিনি শেষ করেছেন, যেগুলো নিয়ে অনেকে বলেছিল এগুলো ‘কখনো শেষ করা যাবে না।’

তিনি যে সংঘাতগুলো তালিকাভুক্ত করেন সেগুলো হলো, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড; কসোভো ও সার্বিয়া; পাকিস্তান ও ভারত; ইসরায়েল ও ইরান; মিসর ও ইথিওপিয়া; আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান; এবং কঙ্গো ও রুয়ান্ডার মধ্যে ‘নৃশংস সহিংস যুদ্ধ’।

তিনি বলেন, অন্য কোনো প্রেসিডেন্ট কখনই এর কাছাকাছিও কিছু করতে পারেননি। জাতিসংঘ এদের মধ্যে কোনো ক্ষেত্রেই ‘সাহায্য করার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি।’

এছাড়াও এই অধিবেশনের আসন বিন্যাসও ইঙ্গিত দেয়, বর্তমান বিশ্ব গত বছরের তুলনায় অনেক ভিন্ন। মার্কো রুবিও এবং নতুন জাতিসংঘ রাষ্ট্রদূত মাইক ওয়াল্টজের মাত্র দুই সারি ওপরে বসে আছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল শারাআ।

তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি একসময় জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন। এমনকি তাকে এখনও কিছু জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার আওতায় রেখেছে।

এদিকে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে রেকর্ড গড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার দীর্ঘ এই বক্তব্য অতীতের সকল মার্কিন প্রেসিডেন্টদের ভাষণের সময়কে ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।

প্রথাগতভাবে প্রতিটি বক্তাকে পরিষদে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কত সময় নিয়েছিলেন? সামান্য বেশি! প্রায় ৫৬ মিনিট।

এটি তার দেওয়া যেকোনো ভাষণের চেয়েও দীর্ঘ, এমনকি জাতিসংঘে দেওয়া অন্য যে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাষণের চেয়েও দীর্ঘ। তবে এই সময়কেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাত। তিনি ১৯৭৪ সালে দেড় ঘণ্টার ভাষণ দিয়েছিলেন।

তবে দুই নেতার রেকর্ডই ম্লান হয়ে যায় কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর সামনে। ১৯৬০ সালে তিনি একবার জাতিসংঘে অবিশ্বাস্য ২৬৯ মিনিট—প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বক্তৃতা করেছিলেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *