চার পদ্ধতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ 

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, চারটি পদ্ধতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ২৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো একাধিক পরামর্শ দিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। 

এর আগে সোমবার অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়িয়েছে। কমিশনের মেয়াদ আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

তিনি বলেন, সনদ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিষয়ে ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাচ্ছি। কারণ প্রধান উপদেষ্টা ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে যাবেন। তবে ব্যর্থ হলে তা ২ অক্টোবরের পরে চলে যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আশা করা যায় যে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে একমত হতে পারবে। এ সময় তিনি গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশসংক্রান্ত বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ভিন্নমত কাটিয়ে উঠে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এদিকে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে চারটি পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। তাদের মতে, এই সনদটি অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট কিংবা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

জানা গেছে, বিশেষজ্ঞ প্যানেল প্রাথমিকভাবে পাঁচটি পদ্ধতির সুপারিশ করেছিল। সেগুলো হলো-অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ। তবে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনার পর জুলাই সনদের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ (ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ) বাস্তবায়নের জন্য সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার প্রস্তাবটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল বাদ দেয়।

উল্লেখ্য, কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেলে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকরামুল হক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ড. শরিফ ভূইয়া ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো আবারও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন এটি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা, এর মাধ্যমে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। অনেকে এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৬ ধারা অনুসরণের কথা বলছেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা সংবিধানের ১০৬ ধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাই না। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। তা এই সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আমাদের চূড়ান্ত মতামত জানাব।

আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের প্রস্তাবকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। বিশেষ করে আমরা আগে থেকেই গণভোটের কথা বলেছি। সেটি নির্বাচনের আগে হোক বা পরে হোক। গণভোট হতে হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে হবে না। কারণ যেখানে এখনই বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধ, সেখানে পরবর্তী সরকার করবে কি না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তিনি মনে করেন নির্বাচন যত দেরি হবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব অ্যাডভোকেট রেদোয়ান আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত বিষয়ে কথা বলেছেন। নতুন করে জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ সামনে আনা হয়েছে। অথচ এর কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই।

তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে ১০৬ ধারা অনুযায়ী আদালতের নির্দেশনার ভিত্তিতে। এটি আমাদের সংবিধানকে পাশ কাটানোর চেষ্টা। এটার পক্ষে আমরা নেই। পরবর্তী নির্বাচন হবে, আমরা সেটাই চাই। নতুন কোনো আদেশের বিষয়টি চাই না। 

তিনি বলেন, যেসব প্রস্তাব সাংবিধানিক নয়, সেগুলো সরকার আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদে কার্যকর হতে পারে।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সরকার নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারও দলগুলোর দিকে বল ঠেলে দিয়েছে। দায় নিতে চাচ্ছে না।

তিনি বলেন, গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি সরকারের কথা নয়। এ নিয়ে হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আরও আলোচনা হবে।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, যদি জনগণ এটি না মানে তাহলে কী হবে? আওয়ামী লীগের যারা ভোট দেবে তাদের ঠেকানোও কঠিন। সর্বসম্মতিক্রমে যা বাস্তবায়ন হয়, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। সরকার আবার দলগুলোর মধ্যে বিভাজন উসকে দিচ্ছে। সরকার দায় নিতে চায় না। তিনি মনে করেন এভাবে সময় বাড়তে থাকলে আওয়ামী লীগের ফেরা সহজ হবে। তাই সবাইকে ছাড় দিতে হবে। সংস্কার ও বিচার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। বিষয়গুলো সরকারকে দেখতে হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের মতামতে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে, জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর ধারা অনুযায়ী এটি করা হবে। অথচ ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী এটি স্ববিরোধিতা। আবার গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। আমরা মনে করি বিদ্যমান সরকার যেভাবে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্ষমতায় আছে, সেরকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না দেখতে হবে। এরপর একটি অধ্যাদেশ হতে পারে।

তিনি বলেন, এমন কোনো পথ নেওয়া উচিত নয়, যাতে বোঝা যায় তা কোনো কর্তৃত্বের মাধ্যমে হচ্ছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া দরকার।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, আইনি ভিত্তি না দিয়ে সনদ করলে এটি বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এক্ষেত্রে ১০৬ অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে এর সুরক্ষার জন্য যে পদ্ধতির কথাই বলা হোক আমরা এর পক্ষে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুররুল ইসলাম আফেন্দি বলেন, সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদে পাস করতে হবে। আর একমত হওয়া বিষয়গুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে করতে হবে। তাছাড়া সংবিধানের ১০৬ অনুযায়ী প্রয়োজনে সনদ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আমরা মনে করি গণভোট সমস্যা আরও বাড়াবে।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, গণভোটের বিষয়টি সংবিধানে নেই। এটি নির্বাচিত সংসদ করবে। তিনি বলেন, আমরা সনদ বাস্তবায়ন চাই। তবে সুরক্ষার জন্য এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কেউ চ্যালেঞ্জ না জানাতে না পারে।

ভাসানী জনশক্তি পার্টির মহাসচিব আবু ইউসুফ সেলিম বলেন, সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জুলাই ঘোষণার ২২ ধারা ২৫-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা মনে করি সংবিধানের ১০৬ ধারা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট মতামত দেবে। আর পরবর্তী সংসদ তা কার্যকর করবে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *