■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
জীবিত স্বামীকে গণঅভ্যুত্থানে নিহত দেখিয়ে শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আল-আমিন (৩৪) নামে ওই ব্যক্তি সিলেট দক্ষিণ সুরমা থানায় গিয়ে তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন।
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩০ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন কুলসুম বেগম (২১)। পরে গত ৮ নভেম্বর মামলাটি এফআইআরভুক্ত করে আশুলিয়া থানা। সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) মো. রকিবুল হোসেনকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মামলার বাদী কুলসুম বেগম স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়েছেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার স্বল্প সিংজুরী বাংগালা গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা দেখিয়েছেন আশুলিয়ার জামগড়া। এজাহারে উল্লেখ করেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট সকালে তাঁর স্বামী মো. আল আমিন মিয়া (৩৪) মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেল ৪টার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় বিজয়মিছিলে তিনিও ছিলেন। তবে পরাজয় মেনে না নিতে পেরে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর স্বামী নিহত হন।
বাদী কুলসুম বেগম বলেন, অনেক খোঁজাখুঁজি করে তিনি স্বামীর সন্ধান পাননি। পরে আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালের ৬ আগস্টের এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পারেন, এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন করেছে। এসব কাগজপত্র হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আছে। পরে তিনি হাসপাতালে থাকা কাগজপত্র, ছবি ও ভিডিও দেখে তাঁর স্বামীর লাশ শনাক্ত করেন।
আশুলিয়া থানায় রাতে আল আমিন বলেন, ‘৫ আগস্ট সে (স্ত্রী) আমার সঙ্গে সিলেটেই ছিল। এর তিন-চার দিন পর ঝগড়া করে মানিকগঞ্জে চলে যায়। এরপর আর তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি। তিন-চার দিন আগে একজনের কাছ থেকে জানতে পারি, আমি ৫ তারিখের (৫ আগস্ট) আন্দোলনে মারা গেছি উল্লেখ করে সে একটা মামলা করছে। ওই মামলার একজন আসামি আমাকে ফোন দিয়া ঘটনাটি বলছে। এটা জানার পর আমি দক্ষিণ সুরমা থানায় গেছি। একটা জিডি করছি, ওসির সঙ্গে পরামর্শ করছি। এরপর ওইখান থেকে আজকে আমাকে আশুলিয়া থানায় পাঠিয়ে দিছে।’
আল আমিন আরও বলেন, ‘আমি জীবিত আছি। আমার স্ত্রী মিথ্যা মামলা করেছে। আমি এখনো মারা যাইনি। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছি। আমি মনে করছি, ওরে কেউ জোরজবরদস্তি করে মামলা দেওয়াইছে বা কোনো চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত।’
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন বলেন, বাদী কুলসুম মিথ্যা মামলা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া আল আমিনকে সিলেট থেকে আশুলিয়া থানায় আনা হয়েছে। তাঁকে আদালতে নেওয়া হবে। সেখানে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেবেন।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুছ ছালাম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানসহ ১৩০ জনের নাম উল্লেখ আছে।
আশুলিয়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) রকিবুল হোসেন বলেন, ‘মামলার বাদীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যাকে মৃত দেখানো হয়েছিল, সেই যুবক বর্তমানে আশুলিয়া থানায় রয়েছেন।’
আল-আমিন বলেন, ‘মামলাটি করেছে আমার স্ত্রী। ১২ আগস্ট পর্যন্ত আমার স্ত্রী মৌলভীবাজারের জুড়িতে ছিল। পারিবারিক ঝামেলার কারণে রাগারাগি হয়। পরে বাবার বাড়িতে চলে যায়। এরপর থেকে আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। আমার ভাইয়ের মাধ্যমে দুই-তিন দিন আগে বিষয়টি জানতে পেরে পরিবারের পরামর্শে থানায় আসি।’
আল-আমিন আরও বলেন, ‘ও (স্ত্রী) আমাকে মৃত দেখিয়ে এতগুলো মানুষকে হয়রানি করছে। তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। আমিতো জীবিত। যখন আমি জীবিত তারা জানবে তখনতো আমার ওপর প্রেশার (চাপ) আসবে। এ জন্য ভয়ে আমি থানায় এসেছি।’ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চেয়ে তিনি স্ত্রীর এমন কর্মকাণ্ডের বিচার চান।
র্যাব-৯ এর মিডিয়া অফিসার সহকারী পুলিশ সুপার মো. মশিহুর রহমান সোহেল বলেন, ‘আমরা কাজ করছি। ভুক্তভোগী নিজেই থানায় এসে হাজির হন।’
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হোসেন বলেন, ‘আল-আমিন তাঁর ভাই ও বাবাকে নিয়ে থানায় এসে ঘটনাটি জানান। তখন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার এসআইকে বিষয়টি জানিয়েছি এবং আল-আমিনকে তাঁদের কাছে পাঠানো হয়েছে।’
এদিকে এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদী ও আল-আমিনের স্ত্রীর এজাহারে দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল করলে অন্য এক ব্যক্তি রিসিভ করেন। তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। তিনি একজন কৃষক। মামলার বাদীর নাম জানানোর পরে, তাঁকে চেনেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই নামে কাউকে চিনি না।’
মামলায় ভুক্তভোগী হিসেবে আল-আমিনের নাম ঠিকঠাক থাকলেও ঠিকানা, বাবার নাম ও মোবাইল নম্বরে অসংগতি রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, স্বামী আল-আমিন পরিবারসহ সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় থাকেন। তাঁকে খুঁজে বের করতে র্যাব-৯ এর সহায়তা নেওয়া হয়। পরে খোঁজ মেলে আল-আমিনের ভাই জাহাঙ্গীর আলমের।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘র্যাব সদস্যরা জানতে চান আল-আমিন কোথায়? তাঁদের বলি, যেখানেই থাকুক আমার ভাই সেইফ আছে। তাঁরা বলেন, সেইফটাই আমাদের দরকার। তখন তাঁদের ঘটনা জানাই। পরে আমার ভাইকে নিয়ে থানায় এসেছি।’