■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের কাছে ইসরায়েলি হামলায় আল জাজিরার পাঁচ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- প্রতিবেদক আনাস আল-শরীফ ও মোহাম্মদ কুরেইকেহ এবং চিত্রগ্রাহক ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নুফাল ও মুয়ামেন আলিওয়া।
তারা সবাই আল-শিফা হাসপাতাল-এর প্রধান ফটকে সাংবাদিকদের জন্য তৈরি এক তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই তাঁবু নিশানা করেই হামলা চালানো হয়।
সংবাদমাধ্যমটি এক বিবৃতিতে বলছে, এই পরিকল্পিত হত্যা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরেকটি স্পষ্ট ও পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ।
আনাস আল-শরীফ ছিলেন গাজার অন্যতম প্রধান সংবাদমুখ, যিনি ইসরায়েলি নৃশংসতা অকপটে তুলে ধরতেন। মাসের পর মাস ইসরায়েলি কর্মকর্তারা তাকে হুমকি দিয়ে আসছিলেন, তবে তিনি উত্তর গাজা ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন।
জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক আইরিন খানসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা আনাস আল-শরীফের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েল তাকে নিয়ে অপপ্রচার চালায় ইসরায়েল এবং দখলদার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আভিখাই আদ্রেয়ি প্রকাশ্যে আনাস আল-শরীফের নাম উল্লেখ করে ভিডিও প্রকাশ করেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কেন রথ বলেন, “এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি স্পষ্টতই টার্গেটেড কিলিং”
গাজার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল প্রায় ২৭০ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীকে হত্যা করেছে।
হামলার কিছুক্ষণ পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) টেলিগ্রাম পোস্টে আনাস আল-শরীফকে নিশানা করে হামলা চালানোর কথা নিশ্চিত করে। আইডিএফের ভাষ্য, শরীফ হামাসের একটি সন্ত্রাসী সেলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
তবে হামলায় নিহত অন্য সাংবাদিকদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি আইডিএফ।
আল জাজিরা জানিয়েছে, এ হামলায় মোট সাতজন নিহত হয়েছেন। শুরুতে সংবাদমাধ্যমটি নিজেদের চার কর্মীর মৃত্যুর কথা দিলেও পরে তা বেড়ে পাঁচজন হয়।
আল জাজিরার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোহাম্মদ মোয়াওয়াদ বিবিসিকে বলেন, আল-শরীফ একজন স্বীকৃত সাংবাদিক ছিলেন এবং গাজায় কী ঘটছে তা বিশ্বকে জানানোর ‘একমাত্র কণ্ঠস্বর’ ছিলেন।
যুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়নি। এ কারণে অনেক সংবাদমাধ্যম গাজার স্থানীয় সাংবাদিকদের ওপর নির্ভর করে খবর প্রকাশ করে।
মোয়াওয়াদ বলেন, “তাদের তাঁবুকে নিশানা করে হামলা করা হয়েছে, তারা তখন ফ্রন্টলাইনে কাজ করছিলেন না।”
তিনি দ্য নিউজরুম প্রোগ্রামকে বলেন, “ইসরায়েলি সরকার আসলে গাজার ভেতর থেকে সংবাদ পরিবেশন বন্ধে সব চ্যানেলকে চুপ করাতে চায়। আধুনিক ইতিহাসে এমনটা আগে কখনো দেখিনি।”
২৮ বছর বয়সী আল-শরীফ মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও এক্স পোস্টে গাজা সিটিতে ইসরায়েলের তীব্র বোমাবর্ষণের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তার মৃত্যুর পরও একটি পোস্ট প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত আগে লেখা ওই পোস্ট তার কোনো বন্ধু প্রকাশ করেছেন।
বিবিসি লিখেছে, হামলার পরের কিছু ভিডিও তারা যাচাই করে দেখেছে। তাতে দেখা যায়, নিহতদের মরদেহ বহন করছে লোকজন। কেউ কেউ চিৎকার করে মোহাম্মদ কুরেইকেহর নাম বলছেন। মিডিয়া ভেস্ট পরা এক ব্যক্তি আনাস আল-শরীফের মরদেহ শনাক্ত করেন।
আল জাজিরার গাজা প্রতিনিধি আনাস আল-শরীফ (২৮) প্রায় ২২ মাস ধরে গাজার বাস্তবতা তুলে ধরে আসছিলেন। জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেওয়া এই সাংবাদিক আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তিনি দুই সন্তানের জনক ছিলেন। গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার বাবার মৃত্যু হয়।
গাজা সিটির শুজাইয়া পাড়ার বাসিন্দা আল জাজিরার আরেক প্রতিবেদক মোহাম্মদ কুরেইকেহ (৩৩) নিজের শেষ সরাসরি সম্প্রচার শেষ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিহত হন। ১৯৯২ সালে জন্ম নেওয়া কুরেইকেহ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। চলতি বছরের মার্চে ইসরায়েলি হামলায় তার ভাই করিম নিহত হন।
জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের আল জাজিরার ক্যামেরাম্যান ইব্রাহিম জাহের (২৫) এবং একই শিবিরের আরেক ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ নুফাল (২৯) নিহতদের মধ্যে ছিলেন। নুফালের মা ও এক ভাই আগে আরেক ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন; তার আরেক ভাই ইব্রাহিমও আল জাজিরায় ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, আল-শরীফের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ কোর্সের তালিকায়’ নামসহ সামরিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আগেও গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশ করেছিল আইডিএফ।
“হামলার আগে বেসামরিক লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে যথাযথ অস্ত্র, আকাশপথে নজরদারি ও অতিরিক্ত গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।”
আল-শরীফের সুরক্ষার দাবিতে গত মাসে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিল আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক, জাতিসংঘ ও কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।
আল জাজিরা বলেছিল, আইডিএফ ধারাবাহিকভাবে গাজার তাদের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে। এটি সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর একটি বিপজ্জনক প্রচেষ্টা।
ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইটস মনিটরের বিশ্লেষক মুহাম্মদ শেহাদা আল–জাজিরাকে বলেন, আল-শরীফের সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার ‘কোনো ধরনের প্রমাণ নেই’। তাঁর ভাষায়, ‘সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই ছিল তাঁর প্রতিদিনের রুটিন।’
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৮৬ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।