ফ্লাইট এক্সপার্ট: বাবা-ছেলে যেভাবে কোটি টাকা আত্মসাতকারী

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

অনলাইন ট্রাভেল বুকিং প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালমান বিন রশিদ শাহ সাইম গ্রাহকদের কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়েছেন। মামলার বাদী ভুক্তভোগী বিপুল সরকার একটি টিকিট এজেন্সির মালিক যিনি কমপক্ষে ১৭টি এজেন্সি মিলে প্রায় ৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেও টিকিট পায়নি।

মতিঝিল থানার মামলায় পুলিশ ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির তিন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। তাঁরা হলেন- হেড অব ফাইন্যান্স সাকিব হোসেন (৩২), চিফ কমার্শিয়াল অফিসার সাঈদ আহমেদ (৪০) ও চিফ অপারেটিং অফিসার এ কে এম সাদাত হোসেন (৩২)। সালমান ও তাঁর বাবা এম এ রশিদ শাহ সম্রাটও মামলার আসামি। তবে দুজনই লাপাত্তা।

সালমান বিন রশিদ শাহ সাইমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন। কানাডার সেন্ট মেরিস ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা শেষ করার আগেই অনলাইন টিকিটিং ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ২০১৭ সাল থেকে অনলাইন ট্রাভেল বুকিং প্ল্যাটফর্ম ফ্লাইট এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।

২০১৮ সালে ‘ফিউচার স্টার্টআপ’ নামের এক প্ল্যাটফর্মে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সালমান বলেছিলেন, ‘আমরা চাই ট্রাভেল হোক সবার জন্য—শুধু ধনীদের জন্য নয়।’ সেই সময় তাঁর প্রতিষ্ঠানে শতাধিক কর্মী কাজ করছিলেন এবং মাসে হাজার হাজার টিকিট বিক্রি হচ্ছিল বলে দাবি করেছিলেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারে নিজের উত্থানের পেছনের গল্প তুলে ধরেছেন সালমান।

তাঁর বাবা এম এ রশিদ শাহ সম্রাট ট্রাভেল এজেন্সি মক্কা গ্রুপ অব কোম্পানিজের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠান মানবসম্পদ রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সদস্য। রশিদ হজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মহাসচিব হিসেবে টানা তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন। লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনালের কাউন্সিল চেয়ারপারসন হিসেবেও কাজ করেছেন।

মক্কা গ্রুপের অধীনে রয়েছে এয়ার টিকিট বিক্রি, মেডিকেল সেন্টার, হজ-ওমরাহ ব্যবস্থাপনা, ট্রান্সলেশন সার্ভিস, মানি এক্সচেঞ্জ, মানবসম্পদ ক্লিয়ারেন্সসহ বহু উদ্যোগ। খুব ছোট থেকে শুরু করে তাঁর বাবা এখন বৃহৎ ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।

২০১৫ সালে কানাডায় থাকতেই বাবার সহায়তায় অনলাইন ট্রাভেল বুকিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায় তাঁর যাত্রা শুরু হয়। ২০১৬ সালের এপ্রিলে দেশে ফিরে এসে মক্কা গ্রুপে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল ব্যবসার ডিজিটাল রূপান্তর।

মক্কা গ্রুপের অধীনে পাঁচটি আইএটিএ লাইসেন্স ছিল, যা সালমানের নতুন উদ্যোগের জন্য সহায়ক হয়। সালমান সাইম Agoda.com ও অন্যান্য ট্রাভেল বুকিং সাইট ঘেঁটে তাদের কার্যক্রম বুঝতে থাকেন। তিনি TBO Group-এর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার অমিত কুমার তিওয়ারির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, TBO Holidays-এর জেনারেল সেলস এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে মক্কা গ্রুপ। এই সময়ে তাঁর দুই পুরোনো বন্ধু—সাদাত হোসেন (ফ্লাইট এক্সপার্টের সিওও) ও আবদুল গনি মেহেদী (সিটিও)—তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। তবে জিএসএ নেওয়ার পর বিদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর অনুমোদন নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর তাঁরা এই অনুমোদন আদায় করতে সক্ষম হন।

দীর্ঘ আট মাসের প্রক্রিয়া শেষে ২০১৭ সালের ১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে অনলাইন ট্রাভেল বুকিং প্ল্যাটফর্ম ফ্লাইট এক্সপার্ট চালু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, ট্রাভেল বুকিংকে প্রযুক্তিনির্ভর, দ্রুত ও সহজ করা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের টিকিট বুকিংয়ের পাশাপাশি হোটেল বুকিং, ট্যুর প্যাকেজ ও ভিসা প্রসেসিংয়ের মতো সেবা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

২০২৪ সালের শেষদিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি সংকটে পড়ে। বিভিন্ন টিকিট এজেন্সি ও গ্রাহক অভিযোগ করতে থাকে, বুকিং করার পরেও টিকিট আসছে না, টাকা ফেরতও মিলছে না। চলতি বছরের জুলাই মাসে পরিস্থিতি চরমে ওঠে।

আর চলতি বছরের আগস্টের শুরুতেই হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট, অ্যাপ ও প্রধান কার্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তালা ঝুলছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ই-মেইল বা ফোন—কোনো মাধ্যমেই ফ্লাইট এক্সপার্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ফেসবুক গ্রুপে একটি পোস্ট দিয়ে সালমান লেখেন, তাঁর দুই সহকর্মী তাঁকে ঠকিয়েছেন এবং তিনি অপবাদ ও হুমকির মুখে দেশ ছাড়ছেন। তিনি দাবি করেন—এটি একটি সাজানো চক্রান্ত।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *