হাজারো ভক্তের অভ্যর্থনায় সিক্ত ফুটবলার হামজা চৌধুরী

■ ক্রীড়া প্রতিবেদক ■ 

লাল-সবুজের জার্সিতে খেলতে দেশে ফিরেছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা ফুটবলার হামজা চৌধুরী। ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে অভিষেক হতে পারে তার। 

সোমবার সকাল ১১টা ৩৪ মিনিটে সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে নামেন হামজা। তাকে বরণ করে নিতে সকাল থেকেই বিমানবন্দর এলাকায় উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। স্মরণীয় এ সফরে তার সঙ্গী মা, স্ত্রী ও সন্তানরা। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়েই বাংলাদেশে এসেছেন হামজা চৌধুরী।

গতকাল বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ২টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ম্যানচেস্টার থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন হামজা। 

হামজা ও তার পরিবারকে সিলেট বিমানবন্দরে হামজাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশ বিমানের স্টেশন ম্যানেজার শাকিল আহমেদ। উপস্থিত ছিলেন বাফুফের ৭ জন নির্বাহী সদস্য সাখাওয়াত হোসেন ভুইয়া শাহীন, কামরুল ইসলাম হিল্টন, গোলাম গাউস, ইকবাল হোসেন, সত্যজিৎ দাশ রুপু, ইমতিয়াজ হামিদ সবুজ ও মন্জুরুল করিম। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার পর হামজাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন তারা। তাদের সাথে রয়েছেন হামজার বাবা মোরশেদ দেওয়ান চৌধুরী। 

এসময় হামজা সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন। শুরুতে হামজা ইংরেজিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিলেও পরে বাংলায় উত্তর দেন। সিলেটিতে বাংলাদেশ দলের জেতার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘ইনশাল্লাহ আমরা উইন খরমু। আমি কোচ হ্যাভিয়ের কাভরেরার লগে মাতছি বহুত্তা। আমরা উইন খরিয়া প্রগ্রেস করতাম ফারমু।’

হামজাকে স্বচক্ষে এক নজর দেখার জন্য সিলেট এয়ারপোর্টের বাইরে অনেক সমর্থক ভিড় করেছেন। কেউ কেউ ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমকর্মীরাও বিমানবন্দরে ভিড় জমিয়েছেন।

হামজা আগেও বাংলাদেশে এসেছেন। তবে এবারের আসাটা বিশেষ। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ফুটবল দলের খেলোয়াড় হয়ে দেশে এসেছেন তিনি। স্মরণীয় এ সফরে তার সঙ্গী মা, স্ত্রী ও সন্তানেরা। 

হামজা চৌধুরী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। তার পরিবার বাংলাদেশি। বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ড যুব দলের হয়ে খেলেছেন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল লেস্টার সিটিতেও খেলেছেন এই মিডফিল্ডার। ভালোবেসে ব্রিটিশ নাগরিক অলিভিয়াকে বিয়ে করেন হামজা চৌধুরী। 

ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া অলিভিয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে ব্রিটেনের গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, হামজাপত্নীর পূর্বনাম ছিল অলিভিয়া ফাউন্টেইন। হামজার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর থেকে নিজেকে অলিভিয়া চৌধুরী হিসেবেই পরিচয় দেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই নামেই পরিচিত। শোনা যায়, ধর্মত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন তিনি। 

২০১৬ সাল থেকেই হামজা চৌধুরীর সঙ্গে প্রণয়ে জড়িয়েছেন অলিভিয়া। সে সময় ফুটবলাঙ্গনে খুব বেশি পরিচিত মুখ ছিলেন না হামজা। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দুজনের প্রণয়ের ব্যাপারে জানতেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন হামজার বাবা মোরশেদ দেওয়ান চৌধুরী। 

অলিভিয়া পেশায় একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। লেস্টার শহরেই নিজের পেশাগত কাজে ব্যস্ত থাকেন বেশিরভাগ সময়। কিশোর বয়সেই ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি। সেখান থেকেই পেশাগত জীবনে পথচলা। 

হামজা-অলিভিয়া দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে। এক কন্যা দুই পুত্র। কন্যা দেওয়ান এনায়া হুসাইন চৌধুরী, দেওয়ান ঈসা হুসাইন চৌধুরী এবং দেওয়ান ইউনুস হুসাইন চৌধুরী। জানা গেছে, নবিদের নামে সন্তানদের নাম রেখেছেন হামজা নিজেই। 

তার আগমনে হবিগঞ্জে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। আগামীকাল ঢাকায় আসতে পারেন হামজা। এরপর যোগ দেবেন জাতীয় দলের ক্যাম্পে।

হামজা চৌধুরী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। তবে এখন তিনি বাংলাদেশেরও নাগরিক। হামজা ছাড়াও দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে লাল-সবুজের জার্সিতে খেলছেন জামাল ভূঁইয়া ও তারিক কাজী। 

আগামী ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে তাদের এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচের জন্য আগামী ২০ মার্চ বৃহস্পতিবার কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে বাংলাদেশ ফুটবলের জাতীয় দল।

কলকাতায় উড়াল দেওয়ার আগে হামজা বুধবার (১৯ মার্চ) ঢাকার টিম হোটেলে বাংলাদেশ দলের অফিসিয়াল সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেবেন। সেখানে তিনি দলের কোচ ও অধিনায়কের পাশাপাশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন।

হামজা চৌধুরীসহ বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দল আগামী বুধবার বিকেলে বা সন্ধ্যায় দলের অফিসিয়াল ফটো সেশনে অংশ নেবেন। এরপর তারা তাদের চূড়ান্ত অনুশীলন শুরু করবেন।

হামজার দেশে আসার বিষয়ে তার বাবা দেওয়ান মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, “মাতৃভূমির প্রতি অসামান্য টানের কারণে সে আসছে। শেকড় যাতে ভুল না যায় সে কারণেই তাকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি। আমি তাকে জোর করিনি। সে নিজের ইচ্ছাতে এসেছে।”

দেশবাসী যে প্রত্যাশা করছে হামজাকে নিয়ে হামজা তা পূরণ করতে পারবেন এমন আশা ব্যক্ত করে হামজার বাবা বলেন, “আজকের দিনটা আমার জন্য আবেগের, আনন্দের। অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছেন এই দিনটির জন্য। ছেলে বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সিতে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলবেন, একজন বাবা হিসেবে এর চেয়ে বড় গর্বের কিছু নেই।”

তিনি জানান, হামজা আজ নিজ বাড়িতে থাকবে। পরদিন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন।

হামজার চাচা দেওয়ান গোলাম মাসুদ বলেন, দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে খেলতে আসছে হামজা চৌধুরী। লন্ডন থেকে সিলেট হয়ে প্রথমে গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামের নিজ বাড়িতে আসবেন হামজা। আমাদের গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে আমার ভাতিজা হামজাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

নিজ গ্রামে হাজারো ভক্তের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত

প্রায় ১১ বছর পর দেশে এসে নিজ গ্রামে হাজারো ভক্তের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়েছেন হামজা দেওয়ান চৌধুরী। সোমবার (১৭ মার্চ) বিকালে হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামে নিজ বাড়িতে তাকে এ উষ্ণ অভ্যর্থনা ও সংবর্ধনা জানায় গ্রামবাসী।

এ সময় লাল সবুজের হয়ে জার্সি গায়ে দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা হামজা দেওয়ান চৌধুরীর বাবা দেওয়ান মোর্শেদ চৌধুরীসহ তার নিকটাত্মীয়রা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নবীগঞ্জ বাহুবল আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সুজাত মিয়া ও হবিগঞ্জ জেলা ফুটবল খেলোয়াড় কল্যান সমিতিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন।

এর আগে সিলেট থেকে সড়ক পথে পরিবার নিয়ে হবিগঞ্জ আসেন হামজা। তার গাড়ি বহরটি স্নানঘাট বাজারে পৌঁছলে সেখান থেকে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার মাধ্যমে তাকে বাড়ি নিয়ে যায় ভক্তরা।

পরে নিজ বাড়িতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সংবর্ধনা মঞ্চে যান হামজা। এ সময় ভক্ত ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দর্শকদের মধ্যে ‘হামজা হামজা’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। 

মাত্র বিশ সেকেন্ডের দেওয়া বক্তব্যে হামজা দেওয়ান চৌধুরী বলেন, ‘আমার খুভ ভালা লাগছে আপনারা যে আইছেন আমারে দেখার লাগি।’ পরে বেশ কয়েকবার ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দেন লেস্টার সিটির হয়ে মাঠ মাতানো এই তারকা ফুটবলার।

হামজা দেওয়ান চৌধুরীকে দেখতে আসা হবিগঞ্জ অনুর্ধ্ব ১৫ দলের কয়েকজন খেলোয়াড় তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে জানান, হামজা চৌধুরীকে একনজর দেখতে এখানে এসেছি। আমার তার আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে একদিন দেশের হয়ে খেলব এবং হামজা চৌধুরী দেশের হয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবেন এই প্রত্যাশা করি।

হবিগঞ্জ জেলা ফুটবল খেলোয়াড় কল্যান সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান বলেন, হামজা শুধু আমাদের জেলার নয় আমাদের দেশের গর্ব। আমরা চাই তার হাত ধরে আমাদের জেলাসহ দেশের ফুটবলের প্রসার হোক।

স্নানঘাট গ্রামের বাসিন্দা আজিজ সিদ্দিকী বলেন, হামজার দেশের প্রতি টান থেকেই এবং দেশের ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থেকেই দেশের জার্সি গায়ে দিতে চলছে। আমরা সবাই তার জন্য দোয়া করি সে যেন দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারে।

এদিকে হামজার আগমনকে ঘিরে পুরো এলাকায় নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সড়কে সড়কে অবস্থান নেয় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা।

৮ নম্বর জার্সির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ

হবিগঞ্জের বাহুবলে স্নানঘাটে আজ সন্ধ্যায় ইফতারের পর হামজার তাঁর সেই বাড়ির উঠোনে হয়ে গেল আগত সাংবাদিকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন। জনাকীর্ণ পরিবেশে সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে অনেক প্রশ্নই করা হয়েছে। কত নম্বর জার্সি পরে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে চান, সেই প্রশ্নের উত্তরে হামজা ৮ নম্বর জার্সির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

হামজা বাংলাদেশের জার্সিতে ৮ নম্বর জার্সি পরার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তার গায়ে সেই লাল-সবুজ জার্সি নাম্বারটা কত হতে পারে, সেটি এখনো নিশ্চিত নয়।

লেস্টার সিটিতে থাকতে তিনি খেলতেন ২০ ও ৩৮ নম্বর জার্সি পরে। লেস্টার থেকে এখন ধারে আসা শেফিল্ড ইউনাইটেডে ২৪ নম্বর জার্সি পরে খেলেন ২৭ বছর বয়সী মিড ফিল্ডার।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *