শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে।

সোমবার (৩০ জুন) সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের খবর সংগ্রহকারী সংবাদকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে এ তথ্য জানান প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম।

খুদে বার্তায় লেখা হয়েছে, আবু সাঈদ হত্যা মামলার ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনাল-২-এ জমা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল রোববার ট্রাইব্যুনাল-২-এ এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের কথা ছিল। তবে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকায় গতকাল তা দাখিল হয়নি।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গত বছরের ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হনছবি: যমুনা টেলিভিশনের ভিডিও থেকে নেওয়া

২৪ জুন চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে আবু সাঈদ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেখানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামসহ ৩০ জনকে এই মামলায় আসামি করা হয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন পার্ক মোড় এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। 

আবু সাঈদ ২০০১ সালে রংপুরের জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে মকবুল হোসেন ও মনোয়ারা বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। আবু সাঈদ ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তিনি স্থানীয় জাফর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপরে স্থানীয় খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জি‌পিএ-৫ পে‌য়ে এসএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ২০১৮ সালে রংপুর সরকা‌রি কলে‌জ থেকে জি‌পিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন। পরে তিনি ২০২০ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইং‌রে‌জি বিভাগে ভ‌র্তি হন। তিনি তার বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

বেরোবির সাবেক প্রক্টরসহ ৩০ জন আসামি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত প্রতিবেদনে আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে ৩০ জনের সম্পৃক্ততার বিষয় উঠে এসেছে।

এর মধ্যে এখন পর্যন্ত চার আসামি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।

এরা হলেন— এসআই আমীর হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর শরীফুল ইসলাম এবং বেরোবির ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এমরান চৌধুরী আকাশ। বাকি পলাতক ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

গত ১৫ জুন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাইদ হত্যা মামলায় আগামী ১৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে এ মামলার শুনানির জন্য ২৬ জুন দিন নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।

আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন, বি এম সুলতান মাহমুদ ও এস এম মঈনুল করিম। আসামি পক্ষে ছিলেন আইনজীবী রাশেদুল হক খোকন ও দেলোয়ার হোসেন সোহেল।

গত ৯ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল এ চারজনকে হাজির করার নির্দেশ দেয় এবং ১৫ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন সাবেক এসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম ও ছাত্রলীগ কর্মী ইমরান চৌধুরী আকাশসহ আরও অনেকে সহায়তা ও উসকানি দিয়েছেন। ওই চার আসামি অন্য মামলায় আগে থেকেই গ্রেফতার ছিলেন।

সেদিন সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করার মধ্যে তাকে গুলি করার ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হলে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিন থেকেই সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন থেকে সারা দেশে ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করা হয়। এরপর একের পর এক মৃত্যু, সরকারি সম্পত্তিতে হামলা, আগুনের মধ্যে ১৯ জুলাই কারফিউ দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি শেখ হাসিনা সরকার। তুমুল গণ-আন্দোলনের মধ্যে ৫ আগস্ট পতন হয় টানা সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসন, শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের আন্দোলনে প্রায় ১৭০০-এর মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় পতিত সরকারের নেতৃত্বে থাকা সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তা এবং মাঠ পর্যায়ে যাদের বিরুদ্ধে গুলি করার অভিযোগ আছে, তাদের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যে ট্রাইব্যুনালটি মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *