:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে অসংখ্য গুম-খুনের হোতা মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে আট দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে (২৪) হত্যার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় শুক্রবার বিকালে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিব এ রিমান্ড আদেশ দেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গত ১৬ জুলাই দোকান কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়েশা বেগম মামলাটি করেন।
আদালতে জিয়াউল আহসানের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে ডিবি পুলিশ। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করেন। তাছাড়া আদালতে জিয়াউল আহসান আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। শুনানি শেষে আদালত ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
একই মামলায় এর আগে গ্রেফতার সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকেও এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ডিবি পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দুজনেরও ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
এর আগে আজ বিকেল ৫টার দিকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে জিয়াউল আহসানকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেওয়া হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
জিয়াউল আহসানের আইনজীবী নাজমুন নাহার আদালতকে বলেন, তাঁর মক্কেল কখনো ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিলেন না। তিনি ‘আয়নাঘর’ বানাননি। ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে। গত ৭ আগস্ট বাসা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।
অপর দিকে বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ উল্লাহ খান আদালতকে বলেন, এই জিয়াউল আহসান গুম-খুনের নায়ক। তিনি ‘জেনোসাইড’-এর সঙ্গে যুক্ত। আয়নাঘরের জনকও তিনি। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার ক্রীড়নক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত। সদ্য সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ২০১২ সালের পর থেকে এক যুগ ধরে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপহরণ ও গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
শুনানির এক পর্যায়ে জিয়াউল আহসান আদালতকে বলেন, ‘আমাকে ৭ আগস্ট বাসা থেকে নিয়ে গেছে। আমি আয়নাঘরে ছিলাম। আমি কোনো আয়নাঘর বানাইনি। আমার হার্টের ৭০ ভাগ ব্লকড। আমাকে স্বেচ্ছায় অবসর দেওয়া হয়েছে। আমি কখনো ধানমন্ডিতে যাইনি। এনটিএমসি কেবল ডিজিটালি গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে। আমার নামে আগে কখনো মামলা হয়নি।’
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (গোয়েন্দা) থাকা অবস্থায় জিয়াউল আহসান বহুল পরিচিত ছিলেন। ওই সময় কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। এ ছাড়া চাকরিচ্যুতের আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে নানা মহলে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়।
এর আগে তিনি ২০০৯ সালের র্যাব-২ এর সহঅধিনায়ক হন। একই বছর তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান এবং র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক নিযুক্ত হন। সে সময় থেকেই তার বিরুদ্ধে মানুষকে গুম করার অভিযোগ উঠে।
২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অসংখ্য গুমের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। ওই ৪ বছর তার ইশারায় চলত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাব। ওই সময়ে তিনি কখনো র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ে প্রধান এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এই দীর্ঘ সময়ে অসংখ্য গুম এবং খুনের ঘটনার নেপথ্য নায়ক ছিলেন জিয়াউল আহসান। ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের সঙ্গেও তার হাত ছিল। কিন্তু নিজের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এবং তৎকালীন র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইদের ওপর সব দায় চাপিয়ে তিনি পার পেয়ে যান। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ থেকে ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিককে অপহরণের ঘটনার সঙ্গেও তার হাত ছিল। র্যাবের যে টিম নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারে জড়িত ছিল তারাই গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিককে অপহরণ করেছিল। এক পর্যায়ে বিভিন্ন মহলের চাপে শেষ পর্যন্ত তাকে মধ্যরাতে মিরপুর এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করে ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যায়।
সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের গুমের ঘটনার সঙ্গে জিয়াউল আহসানের হাত ছিল বলে সেসময় সাংবাদিকদের কাছে খবর আসে। চৌধুরী আলম মারা গেছেন নাকি বেঁচে আছেন তা এখন পর্যন্ত খোলসা হয়নি। এমনকি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনার সঙ্গে জিয়াউল আহসানের হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া এনটিএমসির প্রধান হওয়ার পর জিয়াউল আহসান বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের ফোনে আড়ি পাততেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন। এনটিএমসিতে ল-ফুল ইন্টারসেপশন যন্ত্রপাতি কেনাকাটাতে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে।
এনটিএমসির হাজার কোটি টাকার কেনাকাটায় ২০১৭ সালে ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের পিএস হারুন অর রশীদ বিশ্বাস সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাজার কোটি টাকার এই কেনাকাটায় প্রশ্ন তোলায় এবং বাঁধা দেওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব ও বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিনকে হেনস্তা করেন তারা। এমনকি স্বরাষ্ট্র সচিব হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় তাকে সরিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে বদলি করা হয়। পরে এই সিন্ডিকেট তাদের আজ্ঞাবহ একজন কর্মকর্তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বানান। এরপর এনটিএমসির হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা করে ব্যাপক লুটপাট চালান বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৩ আগস্ট সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতারের দাবি জানায় গুম হওয়ার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। একই সঙ্গে সংগঠনটি জিয়াউল আহসানসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলেও জানিয়েছিল।
গত ৬ আগস্ট এক বিজ্ঞপ্তিতে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে জানিয়েছিল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। আর সেদিনই তিনি এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা তাকে আটকে দেয়।
১৯৯১ সালে জিয়াউল আহসান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার। পরে ২০০৯ সালের ৫ মার্চ র্যাব-২ এর উপ-অধিনায়ক এবং একই বছর লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান।
পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৬ সালের এপ্রিলে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (এনএসআই) পরিচালক হন। পরের বছরের মার্চে তাকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক করে সরকার।
উল্লেখ্য, জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে ফোনে আড়িপাতা এবং গুপ্তহত্যায় শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা দেওয়ার সরাসরি অভিযোগ তুলেছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও বিরোধী নেতারা। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান ঠেকাতে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউনের হোতা ছিলেন তিনি। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে দায়িত্ব পালনকালে তিনি এমন ভূমিকা পালন করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।