:: রাজশাহী প্রতিনিধি ::
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে হামলার অভিযোগে রাজশাহীতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে থানায় সোপর্দ করার পর হাসপাতালে মারা গেছেন।
শনিবার রাতে বিনোদপুর বাজারে তার ওপর হামলা হয় বলে জানিয়েছেন নগরের বোয়ালিয়া থানার ওসি এসএম মাসুদ পারভেজ।
আহত মাসুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সেনাবাহিনী ও পুলিশের তত্ত্বাবধানে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাসুদ মারা যান।
নিহত আব্দুল্লাহ আল মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য।
হামলায় মাসুদের ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাম পা-ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেওয়া হয়েছিল হাতের রগ।
পা হারানো মাসুদ একটি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাচল করতেন। শনিবার রাতের হামলায় তার অপর পাটিও ভেঙে দেওয়া হয়।
গুরুতর আহত হয়ে বোয়ালিয়া থানার হাজতে শুয়ে থাকা অবস্থায় মাসুদ পুলিশকে বলেন, “আমি বিনোদপুরে ওষুধ নিতে এসেছিলাম, ভাই। আমি ছাত্রলীগ করতাম ওই জন্য ধরেছে। কিন্তু আমার পা ২০১৪ সালে কেটেছে ভাই। রগ-টগ সব কাটা, ভাই। আমি তো অনেক দিন আগে থেকেই ছাত্রলীগ করা বাদ দিয়েছি, ভাই।”
ওসি বলেন, ৫ আগস্টের ঘটনায় ওই থানায় কোনো মামলা না থাকায় তাকে বোয়ালিয়া থানায় নেওয়া হয়। কিন্তু গণপিটুনির ঘটনায় গুরুতর আহত ছিলেন আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। বর্তমানে ময়নাতদন্তের জন্য তার মরদেহ মর্গে রয়েছে। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাসুদকে যখন আনা হয়, তখন বোয়ালিয়া থানায় ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার।
৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে হামলাসহ এক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে দুই যুবককে ধরে থানায় এনেছিলেন তিনি। থানায় তিনিও মাসুদকে দেখেন।
মাসুদের মৃত্যুর খবর শুনে সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, “আমরা যে দুজনকে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। তার মধ্যেই আহত অবস্থায় একজনকে আনতে দেখলাম। কিন্তু কারা তাকে এনেছিল তা চিনতে পারিনি। পুলিশের এটা ভালোভাবে দেখা উচিত ছিল।”
ওসি এসএম মাসুদ পারভেজ বলেন, “৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে শনিবার রাতে বিনোদপুর বাজারে মাসুদের ওপর হামলা হয়।
“পরে একদল শিক্ষার্থী তাকে প্রথমে মতিহার থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু মতিহার থানায় আগস্টের সহিংসতার কোনো মামলা নেই। তাই তাকে বোয়ালিয়া থানায় আনা হয় যেন তাকে কোনো সহিংসতার মামলায় গ্রেফতার হয়।”
বোয়ালিয়া থানার ওসি পারভেজ বলেন, “মাসুদের পরিবার অভিযোগ জানালে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
একইদিন বিকেলে নগরীর পঞ্চবটি পদ্মাপাড়ে সানি ও কটা নামের দুই ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার হন ছাত্র-জনতার হাতে। সানি ও কটার বিরুদ্ধে গত ৫ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে মারধর করা হয়। পরে তাদের নগরীর বোয়ালিয়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা নগরীর পঞ্চবটি এলাকার বাসিন্দা। পরে তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, বিকেলে রাজশাহী রেল স্টেশন এলাকায় ছাত্র-জনতার হাতে ধরা পড়ে সানি। এসময় গত ৫ আগস্ট এক ছাত্রীকে ধর্ষণের বিষয়টি সামনে আসে। সানি বিষয়টি স্বীকার করে আরও ছয়-সাতজনের নাম বলেন। তাদের একজন কটা। এসময় সানিকে ধরে কটার সন্ধানে পঞ্চবটির নদীপাড়ে আসে শিক্ষার্থীরা। কটা বিষয়টি টের পেয়ে পদ্মা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে চরে গিয়ে ওঠে। সেখানে ধরা পড়ে ছাত্র-জনতার হাতে গণধোলাইয়ের শিকার হয় কটা। তাকে মারধরের কয়েকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এতে দেখা গেছে, কটার শরীরে কোনো পোশাক নেই। তিনি শুধু প্যান্ট পরে আছেন। আর তাকে মারধর করা হচ্ছে। কেউ শুধু হাত দিয়ে, কেউবা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে কটাকে। পরে কটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাকে দুই হাত ও দুই পা ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে শিক্ষার্থীরা জানান, আহত কটা ও সানি ছাত্রলীগের কর্মী। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কটা ভ্যান চালক আর সানি নগরীতে একটি প্রেসে কাজ করেন। তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরে তাদের নগরীর বোয়ালিয়া থানায় দেওয়া হয়। সেখান থেকে রামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়।
মাসুদ দীর্ঘ দিন বেকার থাকার পর নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন । চিঠিতে একটি চাকরির ব্যবস্থা করারও অনুরোধ করেন।
এরপর ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে মাসুদকে নিয়োগ দিতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর মাসুদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ দেয় কর্তৃপক্ষ। সেই থেকে তিনি এ পদেই চাকরি করতেন।
এর আগে ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে রাবি জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হন আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। এতে মাসুদের ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তার বাম পা মারাত্মক জখম হয়। তার হাতের রগও কেটে দেওয়া হয়েছিল। একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা ওই হামলা চালিয়েছিল বলে ওই সময় তার পক্ষে অভিযোগ করা হয়েছিল। ওই ঘটনার প্রায় ১০ বছর পর প্রাণ গেল তার।
শনিবার নবজাতক শিশুর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে মাসুদ লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার। গত ৩-৯-২০২৪ তারিখে কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছি। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে নেক হায়াত ও সুস্থতা কামনা করি। সব আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুবান্ধবের কাছে আমার ও আমার মেয়ের জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি।’