আয়নাবাজি থেকে আওয়ামীবাজি: একজন গাউসুল আলম শাওন

রাশেদ প্রধান

যে বৈধ সম্পর্ককে অবৈধভাবে আপনাকে জানতে দেওয়া হয় নাই তার নাম “ভায়রা ভাই”। গাউসুল আলম শাওন, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ভায়রা ভাই। বাংলাদেশের সাড়াজাগানো সিনেমা আয়নাবাজির গল্পলেখক শাওন বাস্তব জীবনে করেছে আওয়ামীবাজি। যাত্রাটা শুরু বিপুর হাত ধরে সেটা নিশ্চয়ই নতুন করে আর বলার দরকার নাই। বিপুর হাত ধরে শাওনের সুসম্পর্ক স্থাপন হয়েছে হাসিনাপুত্র জয় এবং রেহানাপুত্র ববির সাথে। একসময় পানি গড়িয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠলো সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ আরাফাতের সাথে। ধীরে ধীরে শাওন পৌঁছে গেলেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পর্যন্ত।

আওয়ামী ক্ষমতাবানদের সাথে পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক আর সৃজনশীল মস্তিষ্ক থাকলে কে থামাবে আপনাকে? শাওনকেও থামানো যায় নাই। আওয়ামী ফ্যাসিজমের জন্য শেখ হাসিনা দায়ী হলে, শেখ হাসিনার ফ্যসিজমকে বৈধতা দেওয়ার জন্য শাওনের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক সমানভাবে দায়ী। জনগণের টাকায় জনগণকে আওয়ামী মিথ্যা উন্নয়নের গল্প বলা আর সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় গল্প বলে নিজেও লুটপাট করা পাল্লা দিয়ে চলেছে। রথ দেখা আর কলা বেচার উদাহরণকে হার মানিয়ে শাওন রথ দেখেছে সাথে জনগণের টাকায় কলা কিনে জনগণকেই বেঁচেছে। সেই কলাও আবার পচা কলা অর্থাৎ মিথ্যে উন্নয়নের গল্প।

আওয়ামী ইভেন্ট মাফিয়া অথবা মিডিয়া ডনদের মাঝে অন্যতম গাউসুল আলম শাওন। ব্যাপারটা শুধুমাত্র অন্যান্য আওয়ামী সুবিধাভোগীদের মত অর্থ লোপাট নয়, গাউসুল আলম শাওনকে বুঝতে আপনাকে আরও গভীরে যেতে হবে। বিজ্ঞাপনী জগতের সৃজনশীল মস্তিষ্ক যখন রাজনৈতিক প্রচারে নিয়োজিত এবং নিবেদিত হয় তখন জনসাধারণের চোখে ধুলো দেওয়া যায়। হামলা-মামলা ভুলে মানুষ দেখে জয় বাংলা। দেশের মানুষের মগজে স্লো পয়জন করে প্রবেশ করানো হয়, জিতবে আবার নৌকা। অর্থাৎ নির্বাচনের আগেই জেনে নাও মেনে নাও নৌকাই জিতবে, আর কোন অপশন নাই।

শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র এবং ফ্যাসিজমকে জায়েজ করা, বিএনপি-জামায়াতকে জঙ্গি বানানোর জন্য পর্দার অন্তরাল থেকে কাজ করা, নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী স্ট্রাটেজি বা কৌশল প্রণয়ন করা, মেরুদণ্ডবিহীন নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, ইনফ্লুয়েন্সার, সেলিব্রেটিদের দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার, সরকারী কাজের নামে আওয়ামী প্রচারণা একচেটিয়াভাবে পরিচালনা করে আপনার আমার ভ্যাট ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা এমনকি বিদেশে পাচার করা, আওয়ামী অপরাধ ঢাকার জন্য বাংলাদেশের মিডিয়া জগতকে নিয়ন্ত্রণ করার অপরাধে ফ্যাসিজমের মিডিয়া ডন গাউসুল আলম শাওন কবে বিচারের আওতায় আসবে? কে বা কারা হাসিনামুক্ত নতুন বাংলাদেশে গাউসুল আলম শাওনকে রক্ষা করছে?

■ ২ ■

আওয়ামী সরকারের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারনার মাস্টারমাইন্ড ছিল হাসিনাপুত্র জয় ও রেহানাপুত্র ববির আওয়ামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআই। সিআরআই এর তত্ত্বাবধানে পতিত সরকারের আমলে প্রচুর ইভেন্ট আয়োজিত হয়েছে, যা সাদা চোখে অনুষ্ঠান মনে হলেও সেগুলো ছিল মূলতঃ আওয়ামী লীগের নির্বাচন পূর্ববর্তী রাজনৈতিক প্রচারনা।

লেটস টক উইথ হাসিনাঃ ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশের তথাকথিত সেলিব্রেটি ইনফ্লুয়েন্সারদের সাথে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আড্ডার ব্যাবস্থা করে শাওন। সেই আড্ডা প্রচার প্রচারণা করা হয় দেশব্যাপী। বিএনপি জামায়াত সহ দেশের সকল গনতন্ত্রকামি রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচন বয়কট করেছে তখন শাওনের প্রচেষ্টা জনগণের চোখ হাসিনার দিকে ঘুরাতে সেলিব্রেটি ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে।

হাসিনা এ ডটার্স টেলঃ ২০১৮ সালে নিশিরাতের ভোটের নির্বাচনের আগে হাসিনা এ ডটার্স টেল নামক চলচ্চিত্র প্রকাশ করা হয়। চলচ্চিত্রটি দিনের পর দিন সিনেমা হলে এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি দেশের টাকা খরচ করে বিদেশেও প্রচার করা হয় চলচ্চিত্রটি। প্রচার প্রচারনার মূল দ্বায়িত্বে ছিল গাওসুল আলম শাওন।

জয় বাংলা কনসার্টঃ আওয়ামী সরকারের রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারনার অংশ হিসাবে ৭ই মার্চ উদযাপনের নামে ২০১৬ সালে শুরু হওয়া জয় বাংলা কনসার্ট ছিল দেশের সবচেয়ে বড় বাজেটের কনসার্ট। আর এই কাজটি একাধিকবার করেছে গাওসুল আলম শাওন।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও মুজিব বর্ষঃ আওয়ামী সরকারেরর সবচেয়ে ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও মুজিব বর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের বৃহৎ অংশের দায়িত্বে ছিল গাওসুল আলম শাওন।

আইসিটি ডিভিশনের উদ্যোগে সিআরআই ও এটুআই এর তত্ত্বাবধায়নে বিগত সরকারের আমলে প্রতি বছর ১৮ই অক্টোবর পালিত হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস যার কেন্দ্রীয় আয়োজক কমিটির সদস্য গাওসুল আলম শাওন। এছাড়াও ডিজিটাল বাংলাদেশ লোগো ক্যাম্পেইন, বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট, বাংলাদেশ শতভাগ বিদ্যুতায়ন উদযাপন, বিদ্যুৎ সপ্তাহ, পথে পথে বিজয়, জোরসে বলো বাংলাদেশ এ ধরনের লোক দেখানো ইভেন্ট ও ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্যই ছিল মানুষকে প্রহসনের নির্বাচন ও শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র ও দুর্নীতি থেকে দূরে রেখে সরকারের প্রতি আস্থা তৈরি করা।

উল্লেখিত অনুষ্ঠানের সবগুলোই বাগিয়ে নিয়েছিল শাওন ও তার প্রতিষ্ঠান গ্রে বাংলাদেশ। হাসিনার আমলে বড় বড় ইভেন্টগুলোর কোনোটিরই সঠিক টেন্ডার হয়নি। লোকদেখানো টেন্ডার আর সিআরআই এর সিধান্তে আগেই কাজ নির্ধারিত থাকতো গাওসুল আলম শাওনের জন্য।

■ ৩ ■

২০২৩ সালে গ্রে বাংলাদেশ থেকে চাকুরিচ্যুত হয়ে গাওসুল আলম শাওন ডট বার্থ নামে নিজের কোম্পানি খুলে বসেন। সিআরআই আশীর্বাদপুষ্ট শাওন ডট বার্থের মাধ্যমে ২০২৩ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুষ্ঠান সহ সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাতের নির্বাচনী প্রচারনার কাজ করে। উল্লেখ্য, সিআরআই কানেকশনের জোরে এটুআই এর অধীনে অবৈধ কোম্পানি গঠনে এটুআই এর অডিও-ভিজ্যুয়াল কোম্পানির পার্টনার ছিল শাওনের ডট বার্থ।

নতুন জন্ম নেওয়া একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা প্রথম আলোর প্রথম পাতা পুরোটা জুড়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার অর্থ কই পায় এই প্রশ্ন থেকেই যায়। নাকি প্রথম আলো যাকে আমি হিন্দুস্তান থেকে পরিচালিত প্রতারণার আলো নামে ডাকি, ফ্যাসিজমের মিডিয়া ডন গাউসুল আলম শাওনকে নিজ কোম্পানির জন্ম উপহার দিয়েছে সেটাও ভেবে দেখতে হবে।

■ ৪ ■

গত ২৭ জুন জাতীয় দৈনিক আমার দেশ অনুসন্ধানী রিপোর্ট এ জানিয়েছে, আওয়ামী আমলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাত থেকে লুটে নেওয়া হয়েছে হাজার কোটি টাকা। হাসিনাপুত্র জয় এবং রেহানাপুত্র ববির আওয়ামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআইয়ের নেতৃত্বে করা হয়েছে জনগণের টাকায় রাজনৈতিক প্রচারণা। সেই অনুসন্ধানী রিপোর্ট এ উঠে এসেছে গাওসুল আলম শাওন এবং গ্রে বাংলাদেশের কথা।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক আইসিটি বিভাগের প্রকাশিত শ্বেতপত্রে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে তার মধ্যে ৮০ কোটি টাকা দুর্নীতি করে ১৯ নম্বরে আছে গাওসুল আলম শাওনের গ্রে বাংলাদেশ। এটা শুধুমাত্র আইসিটি বিভাগের শ্বেতপত্র। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্য) – এর শ্বেতপত্র দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। কোনদিনই জানা যাবে না সিআরআই এবং আওয়ামী লীগের শ্বেতপত্র।

■ ৫ ■

শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র এবং ফ্যাসিজমকে জায়েজ করা, বিএনপি-জামায়াতকে জঙ্গি বানানোর জন্য পর্দার অন্তরাল থেকে কাজ করা, নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী স্ট্রাটেজি বা কৌশল প্রণয়ন করা, মেরুদণ্ডবিহীন নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, ইনফ্লুয়েন্সার, সেলিব্রেটিদের দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার, সরকারী কাজের নামে আওয়ামী প্রচারণা একচেটিয়াভাবে পরিচালনা করে আপনার আমার ভ্যাট ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা এমনকি বিদেশে পাচার করা, আওয়ামী অপরাধ ঢাকার জন্য বাংলাদেশের মিডিয়া জগতকে নিয়ন্ত্রণ করার অপরাধে ফ্যাসিজমের মিডিয়া ডন গাউসুল আলম শাওন কবে বিচারের আওতায় আসবে?

কে বা কারা হাসিনামুক্ত নতুন বাংলাদেশে গাউসুল আলম শাওনকে রক্ষা করছে?

কবে শাওনকে প্রশাসন প্রশ্ন করবে,

শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী গুজব সেল কারা এবং কোথা থেকে পরিচালনা করছে?

জুলাইকে কে লাই অথবা মিথ্যা প্রচার করার কৌশল কার সৃজনশীল মাথা থেকে বের হচ্ছে?

শেখ হাসিনা আসবে বাংলাদেশ হাসবে, এই ধরনের প্রচার কে তৈরি করছে?

লেখক: সহ-সভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *