:: শরিফুল ইসলাম রাজু ::
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পেছনে দায়ী তাঁর সেনাপতি মীর জাফর ও খালা ঘসেটি বেগম। ঘসেটি বেগমের জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত জিঞ্জিরা প্রাসাদে। ঘসেটি বেগম ইতিহাসবিদদের মনোযোগ তেমন পাননি, যে কারণে তার ঢাকা জীবন সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না।
ঘসেটি বেগম দেখতে কেমন ছিল তার সচিত্র উল্লেখ তেমন নেই। ‘আমি সিরাজের বেগম’ গ্রন্থে সিরাজের স্ত্রী লুৎফার বয়ানে তাকে ‘সুন্দরী, চতুর, আভিজাত্যপূর্ণ, বদমেজাজি ও উচ্চাভিলাষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পলাশী যুদ্ধের পর তিনি নিজেও শিকার হয়েছেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের। মীর জাফর নবাব হয়ে ঘসেটি বেগমকে বন্দি করেন। কিছুদিন হীরাঝিলে রেখে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে স্থানান্তর করেন। সেখানে তার সঙ্গে সিরাজের মা, স্ত্রী, কন্যাসহ অনেকজন নারীকেই রাখা হয়। ১৭৬০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই বন্দি ছিলেন ঘসেটি বেগম।
তার মৃত্যু নিয়ে দুই রকম তথ্য প্রচলিত। কোথাও বলা হয়, মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়, তার কবরও সেখানেই। বাংলাপিডিয়া মতে, ১৭৬০ সালে মীর জাফরের ছেলে মীরনের পরিকল্পনায় ঘসেটি বেগম ও আমিনাকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলে, বুড়িগঙ্গায় একটি বজরায় তুলে যাত্রা শুরুর কিছু পরে মাঝনদীতে বজরাটি ডুবিয়ে দেয়া হয়।
তার আসল নাম মেহের-উন-নিসা বেগম। তিনি আলীবর্দী খানের তিন মেয়ের মধ্যে প্রথম। তার বিয়ে হয় চাচাতো ভাই নওয়াজিশ মুহাম্মদ শাহমাত জং এর সঙ্গে, যিনি ঢাকার নায়েবে নাজিম ছিলেন। আলীবর্দী খানের প্রাসাদে তিনি এত প্রভাবশালী ছিলেন যে আলীবর্দী খানের তিন মেয়ের মধ্যে একমাত্র তারই আলাদা প্রাসাদ ছিল। হীরাঝিলের মতোই প্রাসাদের নাম ছিল মতিঝিল। তার ছিল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রবল ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক প্রভাব।
আলীবর্দী খানের কোন ছেলে ছিল না। তিনি ছোট মেয়ে আমিনার বড় ছেলে সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু ঘসেটি চেয়েছিলেন তার পালকপুত্র এবং সিরাজের ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে যিনি অল্প বয়সে গুটিবসন্তে মারা যান।পরে তিনি মেজবোনের ছেলে শওকত জংকে সিংহাসনে বসাতে চেষ্টা করেন। উত্তরাধিকার বিষয়ে তার মতামত গুরুত্ব না পেলেও বড় মেয়ে হিসেবে আলীবর্দী খানের কাছে তিনি গুরুত্ব পেতেন। তার সুপারিশে কেউ পদ হারিয়েছে, কেউ ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছে। ১৭৫৫ সালে স্বামীর মৃত্যুর হলে প্রচুর অর্থের মালিক হোন। তার স্বামী ঢাকার নায়েবে নাজিম থাকলেও ঢাকা পরিচালনা করতেন তিনি। ঢাকার শাসনভার ছিল প্রকৃতপক্ষে ঘসেটি বেগম ও বিশ্বস্ত দেওয়ান, অনেকের মতে প্রণয়ী, হোসেন কুলি খানের হাতে। কারণ নওয়াজিস ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক।
সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর ছিলেন আলীবর্দী খানের সেনাপতি। তরুণ নবাবের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাতে তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে নামে সে। সঙ্গে যোগ দেয় ঘসেটি বেগম, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ ও উমিচাঁদ। সবারই ছিল অভিন্ন উদ্দেশ্য, নবাবকে উৎখাত। অবশেষে ১৭৫৭ এর ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে হেরে যান সিরাজউদ্দৌলা
শ্রী পারাবাতের লেখা ‘আমি সিরাজের বেগম’ গ্রন্থে বলা হয়, পলাশীর যুদ্ধ শেষ হওয়ার খবর মুর্শিদাবাদে পৌঁছার পরই ঘসেটি বেগম ‘নিজের ভুল’ বুঝতে পারেন। পরাজিত নবাব তখনো হীরাঝিলে এসে পৌঁছাননি। সে সময় ঘসেটি বেগম নবাব-পত্নী লুৎফাকে সতর্ক করেছিলেন, ‘যেভাবে, যে পথেই তাঁরা পালান, যেন নদীপথে তাঁরা না যান।’ লুৎফা প্রথমবারের মত ঘসেটি বেগমের চোখে মাতৃত্বের ছায়া দেখেছিলেন। তার বয়ানে তিনি বলছেন, ‘হয়ত নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন ঘসেটি বেগম’।