■ ময়মনসিংহ প্রতিনিধি ■
ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার শিকার দীপু চন্দ্র দাসের পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্র। মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তারাকান্দা উপজেলার মোকামিয়াকান্দা গ্রামে দীপুর বাড়িতে সহমর্মিতা জানাতে গিয়ে এই খবর জানান শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার বলেছেন, ‘দীপুর দাসের সন্তান ও স্ত্রী এবং বাবা-মায়ের দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করল। আমি আসার আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি আমাকে পরিবারটির সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। পরিবারের কী চাহিদা, তা পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে নিরূপণ করা হবে। আমাদের স্থানীয় প্রশাসন আছে, তাদের মাধ্যমে এই যোগাযোগ হবে।’
এ সময় দীপু দাসের বাবা রবি চন্দ্র দাস নিজেদের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরে উপদেষ্টার কাছে ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে পারস্পরিক সম্মান ও সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে বসবাস করে আসছে। একটি রাষ্ট্র ও সমাজ হিসেবে আমরা সব ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মতপ্রকাশের অধিকারকে সম্মান করি। যতক্ষণ পর্যন্ত তা অন্যের প্রতি সম্মান বজায় রেখে করা হয়। মতের আপত্তির মুহূর্তেও কোনো ব্যক্তি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার রাখেন না। বাংলাদেশ একটি আইনশাসিত রাষ্ট্র। অভিযোগ তদন্ত করা ও দায় নির্ধারণ করার একমাত্র কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের। বিশ্বাস বা মতের পার্থক্য কখনো সহিংসতার কারণ হতে পারে না।’
উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘দীপু চন্দ্র দাসের হত্যাকাণ্ড একটি নৃশংস অপরাধ। এর কোনো অজুহাত নেই। আমাদের সমাজে এর কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশ সরকার এই সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। অভিযোগ, গুজব বা বিশ্বাসগত পার্থক্য—এ ধরনের বর্বরতার অজুহাত হতে পারে না। আইনের শাসন বজায় রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ঘটনায় জড়িত ১২ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত চলমান রয়েছে এবং যারা দায়ী, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন তার পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করবে।’
সি আর আবরার বলেন, ‘ধর্ম বা পরিচয়নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। একই সঙ্গে রাষ্ট্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সমাজ একসঙ্গে কাজ করে নিশ্চিত করবে, যেন সহিংসতা কখনোই সহ্য করা না হয় বা জায়গা করে নিতে না পারে। বর্তমানে কিছু দুষ্কৃতকারী গোষ্ঠী বিভাজন সৃষ্টি ও অস্থিরতা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।’
এসব ঘটনায় নির্বাচনে প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে কোনোভাবেই প্রভাব পড়বে না এবং বাইরের দেশের উসকানিতেও নির্বাচনে কোনো প্রভাবে পড়বে না।’
গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে দীপু চন্দ্র দাসকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে উত্তেজিত জনতা। পরে তাঁর মরদেহ বিবস্ত্র করে গাছে ঝুলিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই অপু দাস ১৯ ডিসেম্বর বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করে ভালুকা থানায় মামলা দায়ের করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে।
নিহত দীপু চন্দ্র দাস ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার মোকামিয়াকান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে। দুই বছর ধরে তিনি ভালুকার জামিরদিয়া পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড কোম্পানিতে কাজ করছিলেন।
এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আবদুল্লাহ আল মামুন, তারাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস এম নাজমুস ছালেহীন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের ডুবালিয়াপাড়া এলাকায় গত বৃহস্পতিবার রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার কর্মী দীপু চন্দ্র দাসকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভাজকের একটি গাছে বিবস্ত্র করে ঝুলিয়ে মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তাঁর ভাই অপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে গত শুক্রবার অজ্ঞাতপরিচয় ১৪০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
এদিকে নিহত দীপু চন্দ্রের পরিবারকে অর্থসহায়তা দিয়েছে শ্রীশ্রী জন্মাষ্টমী উদ্যাপন পরিষদ। মঙ্গলবার দুপুরে দীপু চন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে ৫০ হাজার টাকার অর্থসহায়তার চেক তুলে দেওয়া হয়। এ সময় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আশুতোষ দাশ, কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব দে পার্থ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লায়ন রবিশংকর আচার্য্য, চট্টগ্রাম জেলা সৎসঙ্গের সাধারণ সম্পাদক সুমন ঘোষ বাদশা প্রমুখ উপস্থিত।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব দে বলেন, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা এবং হয়রানির অভিযোগ নতুন নয়। বিভিন্ন সময় মিথ্যা অভিযোগ তুলে অনেক নিরীহ মানুষ জেল খেটেছেন। এসব ঘটনার বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। দীপু চন্দ্র দাসের হত্যাকাণ্ড মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করা হোক। পাশাপাশি দীপুর পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
দীপু চন্দ্র হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ। আজ বিকেল চারটায় নগরের গাঙ্গিনার পাড় মোড়ের শহীদ ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে আয়োজক সংগঠনের সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদের সভাপতিত্বে ও সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার আহমেদের পরিচালনায় বক্তব্য দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান, প্রকৌশলী এম এ জিন্নাহ, অধিকারকর্মী অঞ্জন সরকার, আবু বকর সিদ্দিক, নুর আলী চিশতি প্রমুখ। বক্তারা দ্রুত জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
