■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
আওয়ামী লীগের শাসনামলে টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই সেল) গুম করে নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ১০ সেনা কর্মকর্তাসহ ১৭ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
আসামিদের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ এনে এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে অভিযোগ গঠনের প্রার্থনা করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
অন্যদিকে, এই মামলায় আসামিদেরকে অভিযোগ থেকে অব্যহতি চেয়ে আবেদন করেন তাদের আইনজীবীরা।
মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে আজ বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই আদেশ দেন। সেই সঙ্গে এই মামলার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন ও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ২১ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়।
বিচারকার্যের শুরুতেই আসামিদের হয়ে চাওয়া আইনজীবীদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর প্রসিকিউশনের আনা সুনির্দিষ্ট চারটি অভিযোগ পড়ে শোনানো হয় কাঠগড়ায় থাকা ১০ আসামিকে। এসব পড়া শেষে তাদের দোষী নাকি নির্দোষ জিজ্ঞেস করেন বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। বিচারকের এমন প্রশ্নে দাঁড়িয়ে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন প্রত্যেকে। ঠিক তখনই এক সেনাকর্মকর্তা বলেন, “আমরা নিরপরাধ। আমাদের কোনো দোষ নেই। এ আদালতের মাধ্যমে আমরা ইনসাফ পাবো বলে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।”
তাদের কথা শেষে ধন্যবাদ জানিয়ে চেয়ারে বসতে বলেন বিচারক মোহিতুল হক। অভিযোগের ভিত্তি থাকায় মামলার ১৭ আসামির বিরুদ্ধেই বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করা হয়। তবে সূচনা বক্তব্য শুরুর আগে প্রস্তুতি নিতে তিন মাস সময় চান গ্রেপ্তার সাত সেনা কর্মকর্তার আইনজীবী তাবারক হোসেন।
শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে ট্রাইব্যুনালকে এই আইনজীবী বলেন, “প্রসিকিউশন থেকে আমাদের অনেক নথিপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব পড়ে বুঝতে হবে। প্রসিকিউশনের সাক্ষীরা কী বলেছেন তা-ও পড়তে হবে। একইসঙ্গে ঘটনাস্থল (টিএফআই সেল) পরিদর্শন করতে হবে। এছাড়া লিখিত আদেশ পাওয়ার পর ফরমাল চার্জে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) বিরুদ্ধে রিভিউ বা পুনর্বিবেচনার আবেদনের কথাও জানানো হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত সময় না পেলে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়।”
তাবারক হোসেনের এমন আর্জিতে বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, “সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউর (পুনর্বিবেচনা) আবেদনের গ্রাউন্ড (কারণ) বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।”
বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদের এমন কথায় আপত্তি জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। বসা থেকে দাঁড়িয়ে অনেকটা উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, “প্রসিকিউশনের কথা শুনে অর্ডার দিতে হবে। ওনি (তাবারক হোসেন) রিভিউ করবেন, সেজন্য কি ট্রায়াল বসে থাকবে?”
তখন চিফ প্রসিকিউটরের উদ্দেশে বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, “আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। আপনি যেভাবে কথা বলেন, আদালতে এভাবে কথা বলে না। যতক্ষণ না আদেশ পাস করা হচ্ছে, আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না। আমরা কথা বলবো।আপনি কথা বন্ধ করবেন? আমরা অর্ডার দিয়েছি?”
তাদের কথা শুনে আদেশ দেওয়ার কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর। একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার বলেন, “চিফ প্রসিকিউটর, আপনি বসেন।” আর বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, “আমরা কি আপনাকে শুনি না? আপনি কথায় কথায় দাঁড়িয়ে যান কেন?”
তখন চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “আপনি যদি অর্ডার পাস করে দেন।” জবাবে বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, “প্রসিকিউশনের কথা না শুনে আমরা কোনো দিন আদেশ পাস করিনি।”
একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, “একজন শেষ না করতে আরেকজন দাঁড়িয়ে যাওয়া খুবই অপ্রত্যাশিত। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে আশা করবে ট্রাইব্যুনাল।”
এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবীদের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য চার সপ্তাহ সময় দেওয়ার কথা জানান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। তবে চূড়ান্ত আদেশ দেওয়ার আগে নিজের কথা শোনার জন্য বলেন চিফ প্রসিকিউটর। পরে তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য বলেন আদালত।
এ সময় তাজুল ইসলাম বলেন, “ট্রাইব্যুনাল আইনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন থেকে সূচনা বক্তব্যের দিন পর্যন্ত ন্যূনতম তিন সপ্তাহ বা ২১ দিন সময় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই এই তিন সপ্তাহের বেশি সময় যেন না দেওয়া হয়। কারণ এই মামলা ড্র্যাগ (ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা) করতে চাইছে আসামিপক্ষ। যেন বিচার না হতে পারে।”
একপর্যায়ে তিনি বলেন, “সাক্ষীদের হত্যা করা হচ্ছে। চাকু মারা হচ্ছে। মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে ট্রায়াল করতে হচ্ছে। বেশি সময় চাওয়ার উদ্দেশ্য ভালো নয়। যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে যদি সাক্ষীকে মেরে ফেলে, তাহলে বিচার করবেন কীভাবে।”
চিফ প্রসিকিউটর যখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, তখন পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলেন আইনজীবী তাবারক হোসেন। তিনি বলেন, “চিফ প্রসিকিউটরের কথা সঠিক নয়। আমরা বিচারকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছি না। যেটুকু সময় প্রয়োজন, তা-ই চাইছি। আমরাও অভিযোগ করতে পারি চিফ প্রসিকিউটর তাড়াহুড়ো করে বিচার করতে চাইছেন।”
এ সময় আইনজীবী তাবারকের উদ্দেশ্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “আপনি বসেন। আপনি এখানে কথা বলছেন কেন।”
এরপর ট্রাইব্যুনাল উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে এ মামলায় সূচনা বক্তব্য শুরুর আগে চার সপ্তাহ সময় দেন। অর্থাৎ আগামী ২১ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। একই দিন সাক্ষ্যগ্রহণ হওয়ারও কথা রয়েছে।
এই মামলার ১৭ আসামির মধ্যে গ্রেফতার ১০ সেনা কর্মকর্তা হলেন- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, মো. কামরুল হাসান, মো. মাহাবুব আলম এবং কে এম আজাদ; কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও আনোয়ার লতিফ খান (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে); লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান, সাইফুল ইসলাম সুমন ও মো. সারওয়ার বিন কাশেম।
এই মামলায় পলাতক সাত আসামি হলেন- ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ ও র্যাবের সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. খায়রুল ইসলাম।
মামলার প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ৩ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি শেষ হওয়ার পর টিএফআই সেলের বীভৎস পরিস্থিতি তুলে ধরে দীর্ঘ ১৬ বছর পর নতুন এক বাংলাদেশ উদিত হওয়ার মন্তব্য করা হয়। এ মামলায় ৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর ১৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
গত ২২ অক্টোবর সেনা হেফাজতে থাকা ১০ কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। আদালত তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং পলাতক আসামিদের জন্য হাজিরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন। ৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর ১৭ জনের বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।
