■ ক্রীড়া প্রতিবেদক ■
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের হেড কোচ চান্ডিকা হাথুরুসিংহেকে বরখাস্ত করেছে বিসিবি। মঙ্গলবার মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ হাথুরুকে শোকজ ও বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চন্ডিকা হাথুরুসিংহের চুক্তি ছিল আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত। বিসিবির নতুন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই ফারুক আহমেদ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, হাথুরুর বিকল্প কোচ খোঁজার কথা। অবশেষে কোচিং প্যানেল থেকে বরখাস্ত হলেন ৫৬ বছর বয়সি এই কোচ।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, আইনগত কিছু বিষয় থাকায় শুরুতে হাথুরুকে শোকজ ও সাসপেন্ডের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। তারপরেই চুক্তি বাতিলের বিষয়টি আসবে। সব মিলিয়ে চুক্তির মেয়াদ শেষের আগেই তার বাংলাদেশ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটছে।
ফারুক আহমেদ বলেন, ‘বর্তমান কোচের ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করছিলাম। দুই-তিনটা ঘটনা ঘটেছে। এটা দলের জন্য ভালো উদাহরণ ছিল না। শোকজ ও সাসপেনশন দেওয়া হয়েছে। বরখাস্ত করার আগে আমরা তাকে নিয়ম মেনে শোকজ নোটিশ করেছি। এরপর আমরা বরখাস্ত করব। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি পর্যন্ত কোচ ফিল সিমন্স। ’
হাথুরুকে বরখাস্তের কারণ জানিয়ে ফারুক বলেন, ‘দুই-তিনটা ঘটনা ঘটেছে যেগুলো মেনে নেওয়া একজন সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে আমার কাছে খুব পীড়াদায়ক ছিল। এটা ভালো উদাহরণ ছিল না আরকি। তাই ওইদিক বিবেচনা করে আমরা আজকে একটা শোকজ নোটিশ দিয়েছি। আপনারা জানেন এই প্রক্রিয়াগুলো খুব একটা সহজ নয়। আইনি দিক থাকে এগুলোর।’
২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হেড কোচ ছিলেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। কিন্তু সেবার চুক্তির মাঝপথে হাথুরুসিংহে অনেকটা আকস্মিকভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। সেই সময়ে আলোচনা ওঠে, কোনও ক্রিকেটার বা বোর্ড কর্তার সঙ্গে খারাপ সম্পর্কের কারণেই হয়ত দেশ ছাড়েন তিনি। যদিও অনেক পরে এসে জানান, শ্রীলঙ্কার কোচ হওয়ার কারণেই সেই সময়ে বাংলাদেশের দায়িত্ব ছাড়েন তিনি।
২০২৩ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসেন শ্রীলঙ্কার কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। ৩৫ হাজার ডলারে তার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে। যে চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে চুক্তি অনুযায়ী মেয়াদ পূরণ না করে এবারও বরখাস্ত করা হলো হাথুরুসিংহেকে।
দ্বিতীয় মেয়াদে হাথুরুর অধীনে ১০টি টেস্ট, ৩৫টি ওয়ানডে ও ৩৫টি টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ। টেস্টে হারজিত সমানে সমান- ৫টি জয় ও ৫টি হার। তবে ওয়ানডেতে ফল ছিল হতাশাজনক- ৩৫ ম্যাচে ১৩টি জয়, হার ১৯টি, ৩ ম্যাচে ফল হয়নি। টি-টোয়েন্টিতে ৩৫ ম্যাচের ১৯টিতে জিতেছে বাংলাদেশ, হেরেছে ১৫টি, একটিতে ফল হয়নি।
কোচ হাথুরুসিংহেকে নিয়ে পুরোনো দ্বন্দ্ব বিসিবির নতুন বস ফারুক আহমেদের। ২০১৬ সালে দল নির্বাচনে হাথুরুর হস্তক্ষেপের কারণেই প্রধান নির্বাচকের পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন ফারুক। বোর্ড প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার আগে একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ফারুক আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি না বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য হাথুরু খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম।’
ক্রিকেটার নাসুম আহমেদকে চড় মেরেছিলেন হাথুরুসিংহে
বিশ্বকাপের পর জাতীয় দলের এক ক্রিকেটারকে গায়ে হাত তোলার খবর চাউর হয়। জাতীয় দলের এক ক্রিকেটারের গায়ে হাত তোলা যে কোনো বিচারে ঘৃণিত অপরাদ। তবে সে সময় ধামাচাপা দেওয়া হয় সেই খবর। তখন তাকে এমন অভিযোগ থেকে বাঁচান তৎকালীন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপন।
সে অপরাধের কারণে ১১ মাস পর বরখাস্ত হলেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। অভিযোগ ছিল চেন্নাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালে নাসুম আহমেদকে চড় মারেন হাথুরুসিংহে।
২০২৩ সালে ৫ ডিসেম্বর মিরপুরে এ নিযে প্রশ্নে তোলা হলে রেগে যান লঙ্কান কোচ। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘যারা আমাকে একটু হলেও জানে, তারা জানেন, এ রকম কিছু করার মতো লোক আমি কিছুতেই নই। আপনাদের মিডিয়ার মান খুবই নিম্ন পর্যায়ের।’
লঙ্কান কোচকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি সত্যিই নাসুমকে চড় মেরেছিলেন?’ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে এর জবাবে প্রশ্নকর্তাকে লঙ্কান কোচ বলেছিলেন, ‘তুমি কী পাগল’।
এরপর প্রশ্নকর্তা জানতে চান, তাহলে সেদিন কী ঘটেছিল? এর জবাবে হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, ‘আমি জানলেই না বলব যে কী ঘটেছিল!’ নিউজিল্যান্ড ম্যাচের সময় উপস্থিতদের কাছ থেকে সত্যিটা জেনে নেওয়ার চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিলেন লঙ্কান কোচ বলেছিলেন, ‘যারা সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিল, তাদের কাছেই জিজ্ঞেস করে দেখুন না। বুলশিট।’
এর কয়েকদিন পর মিরপুরে একই প্রশ্নের মুখোমুখি হন বিসিবির তৎকালীন সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। গত বছর ৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনা অস্বীকার করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অনেকদিন ধরেই দেখছি। এটা ডাহা মিথ্যা। এরপর আর কিছু বলার নাই। আমি জানি না। আমি কোনো দিনই শুনিনি এমন ঘটনা। আমি এই ধরনের কোনো কথাই শুনিনি।’
পাপন আরও বলেছিলেন, ‘এক্সসেপ্ট যখন নাকি এটা টিভিতে প্রচার করা হলো এবং এখানটায় ফার্স্ট একটা জিনিসই আমি ওনাদের বলেছি যারাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এখানটাই যেটা বলা হয়েছে আমি কোচকে শাসিয়েছি সামথিং লাইক দ্যাট- আমি তো জানি না। সো এরপর আমার তো কিছু বলার নাই। যে জিনিসটা আমি জানি মিথ্যা। সেই জিনিসটা নিয়ে।’
তবে এবার ঠিকই প্রকাশিত হলো প্রকৃত ঘটনা। তদন্তে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন সে সময়ে সেখানে উপস্থিত থাকা একাধিক ক্রিকেটার। অনেকটা চাপে পড়ে এনায়েত হোসেন সিরাজ, মাহবুব আলম ও আকরাম খানকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিসিবি।
বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকা সকলের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কমিটি। কিন্তু প্রকাশ পায়নি তদন্ত কমিটির সেই প্রতিবেদন। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর দেশ ছেড়ে পালান নাজমুল হাসান পাপন।
ফিল সিমন্স ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে পরিচিত নাম
ফিল সিমন্স নামটা ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে পরিচিতই। নব্বই দশকে ক্রিকেটার হিসেবে আরও বেশি পরিচিত ছিলেন সাবেক এই ওপেনার। ২৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে ৪৭ ইনিংসে বেশির ভাগ সময় ওপেনই করেছেন। ১ সেঞ্চুরি ও ৪টি ফিফটিসহ ২২.২৬ গড়ে করেছেন ১০০২ রান। বোলিংয়ে মাত্র ৪ উইকেট।
বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার আগে কোচ সিমন্সের সর্বশেষ জাতীয় দল ছিল পাপুয়া নিউগিনি। জাতীয় দলের বাইরে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
ওয়ানডেতে ১৪৩ ম্যাচে ১৩৮ ইনিংসে ২৮.৯৩ গড়ে ৩৬৭৫ রান করেছেন। ৫ সেঞ্চুরি ও ১৮ ফিফটি। ১০৩ ইনিংসে বোলিং করে নিয়েছেন ৮৩ উইকেট। ৪.৪৪ ইকোনমি রেটে বোলিং করা সিমন্সের ইনিংসসেরা বোলিং সিডনিতে ১৯৯২ বেনসন–হেজেজ সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে। ১০–৮–৩–৪! ওয়ানডে ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সেরা কম রান দিয়ে বোলিংয়ের রেকর্ড (ওভারপ্রতি ০.৩০ রান করে)। ওভারপ্রতি ০.২০ করে রান দিয়ে এ তালিকায় শীর্ষে অস্ট্রেলিয়ার শন অ্যাবোট (৫–৪–১–২)। তবে পুরো ১০ ওভারের বোলিং তালিকায় সিমন্সের ওই স্পেলই সেরা।
১৯৮৮ সালে ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর ১৯৯৯ সালে শেষ ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেন সিমন্স। সেটি ছিল ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অর্থাৎ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম আসার পর বিদায় নিয়েছেন সিমন্স। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকে বছরই ওই দুর্ঘটনাটা না ঘটলে তাঁর ক্যারিয়ার আরও উজ্জ্বল হতো কি না, তা অবশ্য একটা প্রশ্ন। ব্রিস্টলে গ্লস্টারশায়ারের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ট্যুর ম্যাচে ডেভিড লরেন্সের বাউন্সার লেগেছিল সিমন্সের মাথায়। মাথায় হেলমেট ছিল না। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন। থেমে গিয়েছিল হৃৎস্পন্দনও। অস্ত্রোপচারের পর জীবন ফিরে পেয়েছিলেন সিমন্স।