ফটোগ্রাফির সৃষ্টিশীলতা এবং আধুনিক এআই প্রযুক্তির প্রভাব

■ জিয়া রায়হান ■

ফটোগ্রাফি শব্দটি গ্রীক ভাষার দুটি শব্দ “ফটোস” (আলো) এবং “গ্রাফে” (লেখা বা অঙ্কন) থেকে উদ্ভূত, যার আক্ষরিক অর্থ হলো “আলোর মাধ্যমে আঁকা”। ফটোগ্রাফির ইতিহাস প্রায় দু’শত বছর পুরনো, আর এটি সময়ের সাথে একাধিক মাইলফলক স্পর্শ করেছে। ১৮৩৯ সালে ফ্রান্সে লুই দ্য গ্যাগুইর এবং থিওফাইল-গস্তাভে তলব্যর্ট-এর অবদানে প্রথম স্থির চিত্র ধারণের প্রক্রিয়া গণনা করা হয়। প্রথম সফল ফটোগ্রাফ, যা “হলোগ্রাফ” নামে পরিচিত, তা ছিল একটি রূপালী সালফাইড পৃষ্ঠে লিওনার্দো ডা ভিঞ্চির তৈরি করা চিত্রের অনুকরণ।

যেহেতু ফটোগ্রাফির প্রাথমিক দিনগুলোতে এটি একটি জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া ছিল, তাই এটি বিশেষ করে শিল্পীদের, বৈজ্ঞানিকদের এবং সমাজের উঁচু শ্রেণির লোকেদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ফটোগ্রাফি বৃহত্তর জনগণের জন্য সহজলভ্য হয়ে ওঠে। ১৯০০ সালের পর প্রযুক্তিগত উন্নতি যেমন কালো-সাদা থেকে রঙিন ছবি, এবং পরে ডিজিটাল ক্যামেরা উদ্ভাবন, ফটোগ্রাফিকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত করেছে।

ফটোগ্রাফির নান্দনিকতা ও সৃষ্টিশীলতা

ফটোগ্রাফির নান্দনিকতা একটি দৃশ্য বা ঘটনার সৌন্দর্য এবং অনুভূতি প্রদর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফটোগ্রাফি শুধুমাত্র একটি দৃশ্যের একমাত্র রূপ নয়, বরং তা একটি চিন্তা, অনুভূতি, বা একটি মুহূর্তের গভীরতা প্রকাশ করে। ফটোগ্রাফির নান্দনিকতা তৈরি করতে নানা উপাদান যেমন কম্পোজিশন, আলো, রঙ, এবং গভীরতা কাজে লাগে। এছাড়া, সৃষ্টিশীলতা হলো একজন ফটোগ্রাফারের কৌশল, দৃষ্টিভঙ্গি এবং গল্প বলার ক্ষমতার প্রতিফলন। একজন ফটোগ্রাফার তার কাজের মাধ্যমে ব্যক্তিগত অভ্যন্তরীণ অনুভূতি এবং পরিবেশকে বাহ্যিকভাবে চিত্রিত করতে পারেন। যেমন, প্রকৃতির দৃশ্য, মানুষের আবেগ, শহরের কোলাহল অথবা ইতিহাসের কোন ঘটনার পটভূমি সবকিছুই ফটোগ্রাফির মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব।

আধুনিক এআই প্রযুক্তির বিরূপ প্রভাব

প্রযুক্তির উন্নয়ন ফটোগ্রাফির প্রতি অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও, আধুনিক এআই প্রযুক্তির কিছু বিরূপ প্রভাবও রয়েছে। এআই প্রযুক্তি যেমন, ফটো এডিটিং সফটওয়্যার (ফটোশপ, লাইটরুম) অটোমেটেড ছবি তৈরি বা এআই-জেনারেটেড ছবি তৈরির জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন টুল, এসব ফটোগ্রাফির সৃষ্টিশীলতা এবং বাস্তব উপস্থাপনের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

অকৃত্রিমতা এবং কৃত্রিম মনোভাব

এআই প্রযুক্তি যখন চিত্র তৈরি বা সম্পাদনা করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তখন এটি কখনও কখনও ছবির প্রকৃত সৌন্দর্য বা সাদৃশ্য নষ্ট করতে পারে। এমনকি এআই প্রযুক্তি অনেক সময় বাস্তবতার অনুভূতি বা মানবিক সংবেদনশীলতা থেকে সরে যায়, যা ফটোগ্রাফির মৌলিক নান্দনিকতার বিরুদ্ধে যেতে পারে।

আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ফটোগ্রাফির মাধ্যমে যে সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ফুটে উঠত, এআই-জেনারেটেড চিত্রগুলোর মাধ্যমে তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফটোগ্রাফি একসময় একটি ব্যক্তিগত ও মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করতো, কিন্তু আজকাল এই প্রযুক্তি এত দ্রুত ছবি তৈরি করতে সক্ষম যে, তা থেকে সৃজনশীলতা এবং অনুভূতির আসল উপস্থাপনা হারিয়ে যেতে পারে।

গোলমাল সৃষ্টি

এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা ছবিগুলি এখন এত সূক্ষ্ম যে অনেক সময় সেগুলিকে বাস্তব ছবি হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। এই ধরনের ছবির মাধ্যমে মিথ্যা সংবাদ বা “ডিপফেক” এর মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা সত্য এবং মিথ্যার মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

মানবিক সৃষ্টির প্রভাব

এআই প্রযুক্তি যখন সৃজনশীল কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন তা মানুষের সৃজনশীল শক্তিকে কিছুটা পিছিয়ে রাখতে পারে। ফটোগ্রাফির জন্য একজন শিল্পী বা ফটোগ্রাফারের যে শিল্পীসত্তা এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টি ছিল, এআই সেটা কৃত্রিমভাবে নকল করতে পারে, তবে তার মধ্যে মানবিক প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ অনুভূতি থাকে না।

পরিশেষ

ফটোগ্রাফি শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি শিল্প, একটি ভাষা যা মানুষের অনুভূতি, চিন্তা এবং অভিজ্ঞতা প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। যদিও আধুনিক এআই প্রযুক্তি ফটোগ্রাফি এবং ছবির সম্পাদনায় নতুন নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে, তবুও এর কিছু বিরূপ প্রভাবও রয়েছে। এআই ফটোগ্রাফির নান্দনিকতা, সৃষ্টিশীলতা এবং বাস্তব উপস্থাপনের গভীরতা ও মানবিক সংবেদনশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে, যা ভবিষ্যতে ফটোগ্রাফির জগতকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সুতরাং, ফটোগ্রাফি শিল্পের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সৃষ্টির প্রতি সম্মান রেখে প্রযুক্তির উন্নতি ব্যবহার করা জরুরি, যাতে আমরা তার যথাযথ মূল্য এবং আধুনিক সমাজে এর ভূমিকা অনুধাবন করতে পারি।

লেখক: আলোকচিত্রী

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *