■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। শুক্রবার পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানী ইসলামাবাদের একটি দায়রা আদালত এই রায় দেয়।
দায়রা আদালতের বিচারক নাসির জাভেদ রানা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবিকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া তাদের ওপর বড় অঙ্কের জরিমানাও আরোপ করা হয়েছে।
আদালতের রায় অনুসারে, পিটিআই প্রতিষ্ঠাতাকে ১০ লাখ পাকিস্তানি রুপি এবং তাঁর স্ত্রীকে ৫ লাখ রুপি জরিমানা দিতে হবে। জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে, ইমরান খানকে আরও ছয় মাস এবং বুশরা বিবিকে তিন মাস অতিরিক্ত কারাগারে থাকতে হবে।
ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর (এনএবি) প্রসিকিউটর জেনারেল সরদার মুজাফফর আব্বাসির নেতৃত্বে একটি দল আদিয়ালা জেলে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে এই রায় ঘোষণা শোনার জন্য উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন পিটিআই প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী বুশরা বিবি, ব্যারিস্টার গহার আলী খান, শোয়েব শাহিন, সালমান আকরাম রাজাসহ অন্যান্য আইনজীবীরা।
রায় ঘোষণার পর বুশরা বিবিকে আটক করা হয়। তাঁকে এবং এরই মধ্যে কারাগারে থাকা ইমরান খানকে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুই আসামিকে রায়ের সত্যায়িত কপি সরবরাহ করা হয়েছে, যাতে তারা চাইলে আপিল করতে পারেন।
রায়ের ভিত্তিতে ইমরান খান ‘দুর্নীতি’ এবং ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’—এর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, বুশরা বিবি ‘অবৈধ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের’ জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। আদালত আল-কাদির ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইমরান খানকে ১৯৯৯ সালের জাতীয় জবাবদিহি অধ্যাদেশের ৯ (ক) (২) (৪) (৬) ধারা অনুযায়ী এবং বুশরা বিবিকে একই অধ্যাদেশের ৯ (ক) (১২) ধারা অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ১৪৮ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়েছে, বুশরার ভূমিকা দুর্নীতির ঘটনায় সহায়তা ও প্ররোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল, যা তার শাস্তি কমানোর জন্য বিবেচিত হয়েছে।
রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, মামলার অভিযোগপত্রে উপস্থাপিত প্রমাণগুলো বিশ্বাসযোগ্য ও সংগতিপূর্ণ ছিল। তবে, আসামিপক্ষ প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের অযোগ্য প্রমাণ করতে বা কোনো যৌক্তিক সন্দেহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুই আসামি দণ্ডবিধির ২৬৫-ক ধারা অনুযায়ী আবেদন করেছিলেন, যা আদালত খারিজ করে দিয়েছে।
আদালত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে তাদের মামলা প্রমাণ করতে পেরেছে এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি বহাল রাখা হয়েছে।
আল-কাদির ট্রাস্ট মামলা কী
আল-কাদির ট্রাস্ট মামলাটি সাধারণত ১৯০ মিলিয়ন পাউন্ড মামলা নামে পরিচিত। ২০১৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং আরও কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ব্রিটেনের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) থেকে পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠানো প্রায় ৫০ বিলিয়ন রুপি আল-কাদির ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির ফান্ডে সমন্বয় করেছিলেন।
এই অর্থটি মূলত এক প্রভাবশালী আবাসন ব্যবসায়ীর জব্দকৃত সম্পদ সম্পর্কিত। এই সম্পদ পিটিআই সরকারের শাসনামলে এনসিএ বাজেয়াপ্ত করেছিল। সে সময় ব্রিটিশ ক্রাইম এজেন্সি জানিয়েছিল, এই অর্থ পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠানো হবে, তবে এটি একটি নাগরিক মামলা এবং এর মাধ্যমে কোনো অপরাধের প্রমাণ মেলে না।
তবে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো (এনএবি) এই বিষয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করে। ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইমরান এবং তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এনএবি জানায়, ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এনসিএর সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি অনুমোদন করেন, যার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি।
এতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এই অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হবে। কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পরেই আল-কাদির ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, এই কালো টাকার বৈধতা প্রদানে আইনি সুরক্ষা দিতে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল এই ট্রাস্ট।
পিটিআই নেতা জুলফি বুখারি, বাবর আওয়ান, তৎকালীন ফার্স্ট লেডি বুশরা এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফারাহ গোগিকে ট্রাস্টের সদস্য করা হয়। এনএবি আরও অভিযোগ করে, বুখারি চুক্তি অনুমোদনের কয়েক মাস পর ৪৫৮ কানাল জমি পেয়েছিলেন। পরে এই জমি ট্রাস্টে স্থানান্তরিত হয়। এই জমি বর্তমানে ইমরান, বুশরা ও ফারাহের নামে নিবন্ধিত।
মামলার তদন্ত শুরু হলে ২০২৩ সালের ৯ মে ইমরানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট থেকে গ্রেফতার করা হয়। এই প্রথমবার ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর পিটিআই সমর্থকদের দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়, যেখানে সামরিক ও সরকারি স্থাপনা আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
তবে কয়েক দিন পর ইসলামাবাদ হাইকোর্ট ইমরানের জামিন মঞ্জুর করে এবং সুপ্রিম কোর্ট তাঁর গ্রেপ্তারকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেন। যাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী পারভেজ খট্টক ও জুবাইদা জলাল, প্রধান সচিব আজম খান এবং আল-কাদির বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা।
পারভেজ খট্টক সাক্ষ্যে জানান, তখনকার জবাবদিহি উপদেষ্টা মির্জা শাহজাদ আকবর মন্ত্রিসভায় একটি সিল করা নথি উপস্থাপন করেন, যা পাকিস্তান সরকার ও এনসিএর মধ্যে অপরাধমূলক অর্থ ফেরত দেওয়ার একটি চুক্তি ছিল। আজম খান এই তথ্য নিশ্চিত করেন। জুবাইদা জলাল জানান, মন্ত্রিসভাকে ‘অপরাধমূলক অর্থের’ ব্যবসায়ীর কাছে স্থানান্তরের বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি।
মামলায় অন্য ছয় অভিযুক্ত জুলফি বুখারি, ফারাহ গোগি, মির্জা শাহজাদ আকবর এবং জিয়া-উল-মুস্তফা নাসিমকে পলাতক ঘোষণা করা হয়। আদালত তাদের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার নির্দেশ দেয়।
ইমরান আদালতে ১৬ জন সাক্ষীর তালিকা জমা দেন, তবে আদালত তাদের তলব করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় চারজন বিচারক পরিবর্তন হয়, যার মধ্যে ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ বশির, বিচারপতি নাসির জাভেদ রানা, বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ওয়ারাইচ এবং বিচারপতি রানা।