হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরে বড় বাধা ভারত

সিএনএন ■ 

একসময় তিনি ধর্মনিরপেক্ষ নেত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একজন বিপ্লবী নেতার কন্যা। ১৯৭০-এর দশকে বাবার নৃশংস হত্যাকাণ্ডই তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের পথ করে দিয়েছিল। তবে শেখ হাসিনার বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষে পৌঁছানোর পর ঘটে ক্ষমতা থেকে এক অবিশ্বাস্য পতন; যেতে হয় ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে।

শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আর তা কার্যকর হতে পারে, যদি নয়াদিল্লি তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

২০২৪ সালের ছাত্র বিক্ষোভে সহিংস দমন-পীড়ন চালানোয় ক্ষমতাচ্যুত এই নেত্রীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ওই বিক্ষোভে তাঁর সরকারের পতন হয়। ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা ১৫ বছরের শাসনের পর তিনি গত বছরের আগস্টে ভারতে পালিয়ে যান এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের অন্যতম একটি দেশের রাজধানীতে আশ্রয় নেন।

পলাতক ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।  বাংলাদেশ সরকার এই রায় কার্যকর করতে চাইলেও তার বর্তমান আশ্রয়স্থল ভারত তাকে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মুবাশ্বার হাসান বলেন, জনগণের ক্রোধ থেকে বাঁচতে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। তার ভারতে লুকিয়ে থাকা ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া— এটি বেশ অসাধারণ গল্প।

রাজনৈতিক উত্থান ও নির্বাসনের ইতিহাস

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক যাত্রা, ট্র্যাজেডি, নির্বাসন ও ক্ষমতার এমন এক কাহিনি, যা দেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। 

১৯৭৫ সালের আগস্টে এক নৃশংস সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার বাবা, মা ও তিন ভাইকে ঢাকার বাড়িতে হত্যা করা হয়। তখন পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় হাসিনা ও তার বোন প্রাণে বেঁচে যান।

সিএনএন বলছে, হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। এই পরিস্থিতিতে হাসিনা ভারতে ছয় বছরের নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন, যা তার ওপর ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার ছাপ ফেলে।

১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। ক্ষমতায় এসে তার প্রথম কাজ ছিল— ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান ও পরিবারের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের ঘোষণা দেওয়া।

কর্তৃত্ববাদী শাসন

শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর থেকেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ও ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

এক মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী থেকে ক্ষমতা হারানোর পর তিনি যখন ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় ফেরেন, তখন তাকে একজন বদলে যাওয়া নেতা হিসেবে দেখা যায়। তখন তিনি ছিলেন আরও কঠোর এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজের ক্ষমতা সুরক্ষিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। 

পরবর্তী ১৫ বছরে শেখ হাসিনা শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যুগের সূচনা করেন। একই সঙ্গে তিনি ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সমর্থন প্রদান করেন। কিন্তু সমালোচকরা সতর্ক করেন যে, তার সরকার একদলীয় ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক সহিংসতা, ভোটারদের ভয় দেখানো ও বিরোধী ব্যক্তিত্বদের হয়রানির ক্রমবর্ধমান প্রতিবেদন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

২০২৪ সালের অভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনার পতন

গত বছর শুরু হওয়া ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ইতিহাসে ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। সরকারি চাকরির কোটা নিয়ে শুরু হওয়া ছাত্র বিক্ষোভ দ্রুত তার পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভে পরিণত হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের তথ্য মতে, সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল এক নৃশংস দমন-পীড়ন, যার ফলে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। কিন্তু এই রক্তপাত আন্দোলনকে দমন করতে পারেনি; এটি জনগণের ক্ষোভকে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করে যা শেষ পর্যন্ত তার সরকারকে উৎখাত করে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হাসান বলেন, তাকে পালাতে হয়েছিল। এই কাজ নিজের অপরাধ নিজেই স্বীকারের একটি স্বীকৃতি। জনগণ, বাহিনী, সবাই তার বিরুদ্ধে ছিল- কারণ সীমালঙ্ঘন করেছিলেন তিনি। তিনি হত্যা করেছিলেন— তার আদেশে এত মানুষ হত্যার শিকার হয়।

মৃত্যুদণ্ড ও ভারতের অবস্থান

শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তারই প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার করা হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল— বিক্ষোভকারীদের হত্যায় উসকানি দেওয়া, ফাঁসির আদেশ দেওয়া এবং দমন-পীড়নের জন্য মারাত্মক অস্ত্র, ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া। আদালত নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছে যে, ছাত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ তিনি নিজেই দিয়েছিলেন।

যদিও ভারতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আইন আছে, তবুও দেশটি এই রায়টির বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে এবং ‘সব পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে জড়িত থাকার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এদিকে হাসিনার পরিবার নয়াদিল্লিকে আশ্রয় দেওয়ায় প্রশংসা করেছে। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ বলেছেন, সংকটের সময়ে ভারত মূলত আমার মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে।

প্রত্যর্পণে আইনি বাধা

বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিক অনিল ত্রিগুণায়েত মনে করেন, নয়াদিল্লি সম্ভবত শেখ হাসিনাকে জেল বা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করার জন্য দেশে ফেরত পাঠাবে না। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ভারত ও বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তিতে একটি ব্যতিক্রমী নিয়ম আছে। এই নিয়মের ফলে যদি কোনো রাষ্ট্র মনে করে অপরাধটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়েছে, তবে তারা প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

তবে, ত্রিগুণায়েত আরও জানান, যেহেতু হাসিনা এখনও তার সমস্ত আইনি সুযোগ (আপিল) ব্যবহার করেননি, তাই ভারত তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য কোনো তাড়াহুড়ো করবে না।

নতুন নির্বাচনের দিকে বাংলাদেশ

হাসিনার মৃত্যুদণ্ড আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য এক উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায় তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ, এর নেতৃত্বও ছত্রভঙ্গ হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার জাতিকে তার গভীর মেরুকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের করে আনার এক বিরাট দায়িত্বের মুখোমুখি হয়েছেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বিভেদ ভুলে মিলেমিশে থাকার মতো অবস্থা থেকে অনেক দূরে।’ তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ হয়তো আবার রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে, যদিও তা হাসিনার নেতৃত্বে হওয়ার মতো নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বেগম খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও অন্যান্য ছোট দলের জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র উন্মুক্ত করলেও গভীর বিভাজনগুলো সহজে সমাধান করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনার পতন কি একটি বিষাক্ত যুগের সমাপ্তি, নাকি কেবলই অনিশ্চিত এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা?

কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভারত

এক দশকের বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা ছিলেন ভারতের সবচেয়ে অটল আঞ্চলিক মিত্রদের একজন। তাঁর সরকার ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমনে সহায়ক ছিল, যারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর আগে দুই দেশের বিস্তৃত সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার জন্য শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছিলেন। এখন তাঁর সরকারের পতন হওয়ায় নয়াদিল্লিতে বড় ধরনের নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে উগ্রবাদী ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন এমন একজন ভারতীয় কূটনীতিক অনিল ত্রিগুণায়েত। তিনি বলেন, নয়াদিল্লি শেখ হাসিনাকে কারাজীবন বা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে নিজ দেশে ফেরত পাঠাবে, সে বিষয়ে তাঁর (অনিলের) যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

সাবেক এই নেত্রী তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এটি ভারতকে এমন একটি সম্ভাব্য ভিত্তি তৈরি করার সুযোগ দিচ্ছে যে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

ভারতের প্রত্যর্পণ আইন, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির প্রত্যর্পণ চুক্তিতেও ‘রাজনৈতিক অপরাধের’ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা এ ধরনের পরিস্থিতির জন্যই মূলত যুক্ত করা হয়েছে। এটি কোনো একটি দেশকে কারও অপরাধের ধরন রাজনৈতিক হলে তাঁকে প্রত্যর্পণের আবেদন প্রত্যাখ্যানের সুযোগ দিয়েছে।

অনিল ত্রিগুণায়েত বলেন, ‘ভারতকে এটাকে রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে দেখতে হবে, মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে নয়; যে অপরাধে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।’

অবশ্য অনিল ত্রিগুণায়েত উল্লেখ করেন যে শেখ হাসিনা এখনো সব আইনি প্রতিকার শেষ করেননি। তিনি রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারেন। এরপর হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা সাবেক এই ভারতীয় কূটনীতিক বলেন, ‘যেহেতু সব প্রতিকার শেষ হয়নি, তাই ভারত তাঁকে পাঠানোর জন্য তাড়াহুড়ো করবে না।’

যেদিন শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়, ওই দিনই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘বিলম্ব না করে’ তাঁকে হস্তান্তর করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানায়। মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী এটি ভারতের দায়িত্ব।’

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের জন্য এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ এবং দলটির নেতৃত্ব ছত্রভঙ্গ হওয়ায় নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গভীরভাবে দ্বিধাবিভক্ত দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে জাতিকে বের করে আনার এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি রয়েছে।

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল–বিএনপি এবং অন্য ডজনখানেক ছোট দলের জন্য ভবিষ্যতের যেকোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পথ খুলে দিয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এতে দীর্ঘদিনের গভীর বিভেদ সহজে সমাধান না–ও হতে পারে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বিভেদ ভুলে মিলেমিশে থাকার মতো অবস্থা থেকে অনেক দূরে।’ তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ হয়তো আবার রাজনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে, যদিও তা হাসিনার নেতৃত্বে হওয়ার মতো নয়।

এখন প্রশ্ন হলো—শেখ হাসিনার বিদায় কি একটি বিষাক্ত যুগের অবসান ঘটাবে নাকি কেবলই অনিশ্চয়তার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *