■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
ভারতের মহারাষ্ট্রের সাবেক মন্ত্রী মুম্বাইয়ের জনপ্রিয় রাজনীতিক বাবা সিদ্দিকিকে (৬৬) গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শনিবার রাতে মুম্বাইয়ের বান্দ্রা পূর্ব এলাকার নির্মল নগরে কোলগেট মাঠের কাছে তাঁকে গুলি করে আততায়ীরা।
পুলিশ বলছে, গতকাল রাতে কোলগেট মাঠের কাছে ছেলে জিশান সিদ্দিকির অফিস থেকে বের হন বাবা সিদ্দিকি। গাড়িতে ওঠার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে ছয়টি গুলি করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁকে স্থানীয় লীলাবতী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় পুলিশ ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গেছেন। কেন তাঁকে নিশানা করে এভাবে গুলি চালানো হলো, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
১৫ দিন আগে খুনের হুমকি পান বাবা সিদ্দিকি। প্রাণহানির হুমকি পাওয়ার পর তাকে ওয়াই ক্যাটাগরির নিরাপত্তাও দেওয়া হয়৷ কী কারণে তার ওপর হামলার ঘটনা হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। তবে হামলায় জড়িত তিনজনের মধ্যে দুজনকে আটক করেছে পুলিশ।
লীলাবতী হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. জলিল পারকার সাংবাদিকদের বলেন, “রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাবা সিদ্দিকিকে এখানে নিয়ে আসা হয়। যখন তাকে ইমার্জেন্সি রুমে নেওয়া হয়, তখন তার নাড়ি বা রক্তচাপের কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। ইসিজিতেও তাই। আমরা তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করি।
“তার বুকে গুলি ঢুকেছিল। রাত ১১টা ২৭ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।”
ঘটনা তদন্তে মুম্বাই পুলিশ চারটি বিশেষ দল গঠন করেছে। প্রাথমিক তদন্তের পর তারা বলছে, ভাড়াটে খুনি দিয়ে বাবা সিদ্দিকিকে হত্যা করা হয়েছে।
মুম্বাই পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ডে তিন বন্দুকধারী জড়িত ছিল। তিনজনের মধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে- গুরমাইল বালজিৎ সিং (২৩), তার বাড়ি হরিয়ানায় এবং ধর্মরাজ কাশ্যপ (১৯) তার বাড়ি উত্তরপ্রদেশে। তৃতীয় জন শিব কুমার গৌতম বলে চিহ্নিত হয়েছে, সে পলাতক; তার বাড়িও উত্তরপ্রদেশে। সবাই লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য।
তবে চতুর্থ কোনও ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে, তাকেও খোঁজা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ।
কী কারণে খুন হতে হলো মহারাষ্ট্রের সাবেক এই মন্ত্রীকে, তদন্তে নেমে তার সম্ভাব্য সব দিক খতিয়ে দেখছে মুম্বাই পুলিশ।
মুম্বাই পুলিশের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ভাড়াটে খুনির তত্ত্ব, ব্যবসায়িক শত্রুতা, না কি বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্প—খুনের নেপথ্যের প্রতিটি প্রশ্নকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখছে পুলিশ।
নিজেকে বিষ্ণোইয়ের দলের সদস্য বলে দাবি করে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন এক সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারী, যা এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি মুম্বাই পুলিশ। আর এই গ্যাংও দায় স্বীকার করেনি।
মহারাষ্ট্রের ভোটের আগে বান্দ্রা পশ্চিমের তিনবারের এই বিধায়ককে হত্যাকাণ্ডের পর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
বাবা সিদ্দিকির ছেলে জিশান সিদ্দিকি বান্দ্রা পূর্বের বিধায়ক। বাবা সিদ্দিকি যে তার ছেলের অফিসের ওখানে অবস্থান করছে, এই তথ্য দুর্বৃত্তরা আগে কীভাবে জানতে পারল—তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
হত্যাকাণ্ডের আগে খুনিরা ঘটনাস্থলটি এক মাস ধরে রেকি করেছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে মুম্বাই পুলিশের অপরাধ শাখাকে জানিয়েছে গ্রেফতার হওয়া দুজন।
পুলিশের এই শাখা বলছে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজন বৃহস্পতিবার রাতে অটোরিকশায় করে সেখানে পৌঁছায় এবং গুলি চালানোর আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।
সন্দেহভাজনরা কয়েক মাস ধরে সিদ্দিকের ওপর নজরদারি করছিল, তার বাসভবন ও অফিসে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। তারা বলছে, খুনিদের প্রত্যেককে জন্য আগাম ৫০ হাজার রুপি করে দেওয়া হয়েছিল। আর হত্যার মাত্র কয়েক দিন আগে তাদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিষ্ণোই গ্যাং জড়িত, নাকি বস্তি পুনর্বাসন কিংবা রাজনীতি সম্পর্কিত কিছু—তা তদন্ত করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
মুম্বাইয়ে বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল; সেই মামলার তদন্ত চালাচ্ছে ভারতের অর্থনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। মামলায় নাম জড়িয়েছিল সিদ্দিকিরও।
২০০০-২০০৪ সাল পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের আবাসন ও নগরোন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বাবা সিদ্দিকি। সেই সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি সংস্থাকে বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।
মামলার তদন্তে ২০১৮ সালে সিদ্দিকির ৪৬২ কোটি টাকার সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করেছিল ইডি।
চলতি বছরেই কংগ্রেস ছেড়ে অজিত পওয়ারের এনসিপিতে যোগ দিয়েছিলেন সিদ্দিকি। ওয়াই ক্যাটেগরির কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাও পেতেন। তারপরও কীভাবে এই ঘটনা ঘটে গেল, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
বিশেষ করে সামনেই মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। তার ঠিক আগেই সিদ্দিকির খুনের ঘটনায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ঘটনায় এখনও পর্যন্ত যে দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তারা কেউই মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা নন। এক জনের বাড়ি হরিয়ানায়। অন্য জন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা।
ফলে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণের কোনও কিছু এই হত্যাকাণ্ডের যুক্ত কি না—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বলিউডের একাধিক তারকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন সিদ্দিক। জাঁকজমকপূর্ণ পার্টি আয়োজনের জন্য তার সুনাম ছিল। অতীতে তার আয়োজিত ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন শাহরুখ খান, সালমান খান ও সঞ্জয় দত্তের মতো বড় তারকারা।
বাবা সিদ্দিকি ১৯৯৯ সালে প্রথম বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। বান্দ্রা এলাকার জনপ্রিয় নেতা তিনি। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনবার ভোটে জিতলেও ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে বান্দ্রা পশ্চিম কেন্দ্র থেকে তিনি হেরে গিয়েছিলেন।
বাবা সিদ্দিকি ২০০০ সালে কংগ্রেস-অবিভক্ত এনসিপি সরকারের খাদ্য ও নাগরিক সরবরাহ, শ্রম, খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এবং ভোক্তা সুরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
বাবা সিদ্দিক হত্যায় সন্দেহভাজন লরেন্স বিষ্ণোই
বাবা সিদ্দিককে হত্যার পর সন্দেহের তির যাচ্ছে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের দিকে। কারাগারে থাকা এই ব্যক্তি একটি কুখ্যাত গ্যাংয়ের মূল হোতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই গ্যাং হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
ধারণা করা হয়, বিষ্ণোই গ্যাংয়ে অস্ত্র চালাতে দক্ষ এমন ৭০০ সদস্য রয়েছেন। তাই গতকালের ঘটনার পর গ্যাংটি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
লরেন্স বিষ্ণোই ১৯৯৩ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন কেটেছে রাজ্যের আবোহার শহরে। এরপর তিনি ডিএভি কলেজে ভর্তি হতে চণ্ডিগড়ে পাড়ি জমান। ২০১১ সালে যোগ দেন পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস স্টুডেন্টস কাউন্সিলে। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় ‘গ্যাংস্টার’ গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে। এরপর ধীরে ধীরে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। রয়েছে হত্যা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ। যদিও এসব অভিযোগের কোনোটাই স্বীকার করেননি তিনি। নিজের গ্যাংয়ের এই সদস্যদের মাধ্যমে কারাগারে বসেও বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে চণ্ডিগড়ে অপরাধ কর্মকাণ্ড শুরু করেন বিষ্ণোই। ২০১৩ সাল নাগাদ তিনি ত্রাস সৃষ্টিকারী এক চরিত্রে পরিণত হন। কয়েকটি হত্যার ঘটনার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁর গ্যাং মদ বেচকেনা ও অস্ত্র চোরাচালানে অর্থ লগ্নি করা শুরু করেন। হত্যাকারীসহ ভয়ংকর সব অপরাধীদেরও আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে আসছেন তাঁরা।
২০১৪ সালে রাজস্থান পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয় লরেন্স বিষ্ণোইয়ের। এরপর তিনি কারাবন্দী হন। সেখান থেকেই আরও সংঘবদ্ধভাবে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। কারাগারে থাকাকালে জস্বিন্দর সিং রকি নামের আরেক অপরাধীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে তাঁর। ২০১৬ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রকি।
বন্দী অবস্থায়ও লরেন্স বিষ্ণোইয়ের প্রভাব–প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছিল। রাজস্থানের ভারতপুর জেলায় যে কারাগারে তিনি বন্দী ছিলেন, সেখানকার কর্মকর্তাদের হাত করে নানা কার্যসিদ্ধি করতেন। ২০২১ সালে তাঁকে সেখান থেকে দিল্লির তিহার কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। এই কারাগারের কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, আইপি কলের মাধ্যমে গ্যাংয়ের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বিষ্ণোই।
লরেন্স বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে খালিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে। এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ভারতের শিখ সম্প্রদায়ের জন্য পাঞ্জাবে ‘খালিস্তান’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চান। ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এনআইএ) তথ্যমতে, বিষ্ণোই ও গোল্ডি ব্রার—দুজনই খালিস্তানপন্থী।
লরেন্স বিষ্ণোইয়ের নাম নতুন করে সামনে আসে ২০২২ সালে। সে বছরের ২৯ মে পাঞ্জাবের জনপ্রিয় গায়ক সিধু মুসওয়ালাকে হত্যা করা হয়। বিদেশ থেকে ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন গোল্ডি ব্রার। জানান, বিষ্ণোইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুসওয়ালাকে হত্যা করেছেন তিনি। তখন বিষ্ণোই দিল্লির তিহার কারাগারে বন্দী ছিলেন।
এ ছাড়া ২০২৩ সালে ভারতের ডানপন্থী নেতা সুখদেব সিং গোগামেদিকে জয়পুরে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সুখদেবের সঙ্গে অস্ত্রধারী একজন চা পান করছেন। তিনিই গুলি চালান। পরে বিষ্ণোইয়ের গ্যাংয়ের সদস্য রোহিত গোদারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে সুখদেবকে হত্যার দায় স্বীকার করেন।
২০১৮ সালে বলিউড তাঁরকা সালমান খানকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে বিষ্ণোই গ্যাং। সে বছর মুম্বাইয়ে সালমানের বাসায় হানা দেন সাম্পাথ নাথ নামে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের এক সদস্য। তিনি দাবি করেন, কালো হরিণ শিকারের কারণে সালমানকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁর ওপর। বিরল প্রজাতির এই হরিণকে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন।
সালমান খানকে সরাসরি হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন লরেন্স বিষ্ণোই। ভারতের যোধপুরে আদালতে এক শুনানি চলাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘সালমান খানকে এই যোধপুরেই হত্যা করা হবে। তারপর তিনি আমাদের সত্যিকারের পরিচয় জানতে পারবেন।’
এরপর ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় সালমান খানের বাসার বাইরে গুলি চালানো হয়। এই এলাকাতেই গতকাল হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বাবা সিদ্দিক। সালমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও ছিল তাঁর। সালমানের বাসার বাইরে গুলির পর সে সময় পুলিশ জানিয়েছিল, এ কাজের জন্য দুজনকে ভাড়া করেছিল বিষ্ণোই গ্যাং।