■ মোহাম্মদ আবু সাঈদ ■
১. মুঘলের লাখেরাজ
সুলতান ও মোঘলদের সাথে সুফিদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক কিভাবে বজায় থাকতো? লাখেরাজ সম্পত্তির মাধ্যমে। যেসব পীর মুরশেদ সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠতো, তাদেরকে সুলতান, মুঘলরা লাখেরাজ সম্পত্তি দিতেন। এই সম্পত্তি দিয়ে তারা কী করতেন?
ভক্ত-মুরিদরা চাষ করতেন। ফসল দিয়ে খানা পাকানো হতো লঙ্গরখানায়। লঙ্গরখানার মূল যোগান আসতো লাখেরাজ সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত ফসল থেকে। পীরের কোনো ভক্ত-মুরিদ বেকার বসে থাকতেন না, লাখেরাজ সম্পত্তিতে চাষ করতেন, ফসল খানকায় তুলতেন। খানকা ছিল মুরিদদের থাকার জায়গা, লঙ্গরখানা খাবারের। পীর সাহেবের আশ্রয় প্যাকেজ।
ইংরেজরা ১৭৯৩ সালে আইন করে। বলা হয়, লাখেরাজ সম্পত্তি যারা ভোগ করছেন তাদের কাছে সুলতান/মুঘলদের দেওয়া সনদ/দলিল যাচাই করা হবে। সনদ/দলিল যাচাই সাপেক্ষে স্থানীয় কালেক্টর অফিসে রেজিস্ট্রেশন করা হবে।
সুলতান, মুঘলরা আর কতজনই বা লিখিতভাবে সম্পত্তি দিতেন? আর যদিও দিতেন কতজন তা যত্ন সহকারে সংরক্ষণে রাখতেন? বেশিরভাগ লাখেরাজ সম্পত্তির সনদই পরবর্তী উত্তরাধিকার যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করেননি। বাংলার আবহাওয়াও কাগজ সংরক্ষণের উপযোগী নয়। ঝড় বৃষ্টিতে স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে, কাঠেতে একটা কাগজ কতদিন টিকে থাকতে পারে সেটাও প্রশ্ন।
আইন পাশের পর, ইংরেজ আদালত তলব করতে থাকলো লাখেরাজ সম্পত্তি ভোগ করা দরবারগুলোকে। যে উপযুক্ত সনদ দেখাতে পারলো, তার সম্পত্তি থাকলো ; যে দেখাতে পারলো না তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো। এমনও অনেক ঘটনা আছে, সনদ আছে কিন্তু ‘যাচাইকরণ’র অজুহাতে যুগের পর যুগ মামলা স্থগিত করে রাখা হয়েছে। যখন ফেরত পেয়েছে ততদিনে দরবারের ১২টা বেজে গেছে!
১৮২২ সালে আরেকটা আইন হয়, উপযুক্ত সনদ না দেখাতে পারলে লাখেরাজ সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় বাজেয়াপ্ত ও রাষ্ট্র কর্তৃক উক্ত সম্পত্তি পরিচালনার আইন। ১৮২২ থেকে ১৮৪০— এই ১৮ বছর বাংলাদেশের অধিকাংশ লাখেরাজ সম্পত্তি ‘উপযুক্ত সনদ’ না থাকার অজুহাতে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
মুঘল আমলের বাংলাদেশে পীর-দরবেশদের দরবারী জৌলুস, ভরপুর লঙ্গরখানা, প্রভাবশালী খানকা কেন ইংরেজ আমলে স্রেফ নাই হয়ে গেলো? তার পেছনে মূল কারণ, লাখেরাজ সম্পত্তির বাজেয়াপ্তি। খানকাগুলো রাতারাতি জনশূন্য হয়ে গেলো, লঙ্গরখানায় আর আগুন জ্বললো না। যে জমিদার মুরিদ খানকায় নিয়মিত দান করতেন, সূর্যাস্ত আইনের আওতায় তার জমিদারির যায় যায় অবস্থা!
অর্থনীতি সমাজের প্রধান চালিকাশক্তি। ইংরেজরা মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করে দিয়েছে, সিস্টেম আমূল বদলে দিয়েছে ; মালিক থেকে গোলাম হয়ে গেছে মুসলমান সমাজ।
ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের লড়াই, ফরায়েজী আন্দোলন— সবগুলোই ছিল অর্থনৈতিকভাবে গোলামে পরিণত করার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া।
যারা যৌক্তিকভাবেই অভিযোগ করেন, ইংরেজপূর্ব বাংলাদেশে সুফিদের, পীর-দরবেশদের যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রভাব ছিল তা কেন এখন নাই? তার মূল কারণ এইখানে তালাশ করতে হবে। অর্থনৈতিক অর্ডার ধ্বংস করে দিয়ে পীর-দরবেশদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে। যা থেকে আজ ২০০ বছর পরও বের হতে পারেনি তারা।
মুঘলদের তৈরি করা অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে ইংরেজরা নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করে, যার প্রধান ভুক্তভোগী মুসলমান সমাজ, প্রধানত লাখেরাজ সম্পত্তির মাধ্যমে। ইংরেজদের তৈরি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রবেশ করতে মুসলমানদের লেগে যায় ১০০/১২০ বছর। এই ফাঁকে হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদের চেয়ে ১০০/১২০ বছর এগিয়ে যায়। যার প্রভাব এখনো দৃশ্যমান।
২. হিন্দুত্ববাদের ওয়াকফ বিল
লাখেরাজ সম্পত্তির মাধ্যমে যা করা হয়েছিল, ভারতের ওয়াকফ বিল সংশোধনের মাধ্যমে ঠিক তাই করা হচ্ছে। এমনিতেই মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘু, নিপীড়িত নির্যাতিত ; ওয়াকফ সম্পত্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে যতটুকু দাঁড়িয়ে ছিল সামাজিক পর্যায়ে সেটাও ধ্বংস করার হিন্দুত্ববাদী বন্দোবস্ত— ওয়াকফ বিল।
ভারতের সবচেয়ে বেশি জমি তিনটি খাতের আওতায়— রেল, প্রতিরক্ষা এবং ওয়াকফ। এই ওয়াকফ সিস্টেম ধ্বংস করার মাধ্যমে ইন্ডিয়ায় মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে যতটুকু স্থিতিশীলতা ও আধিপত্য আছে সেটাকে বিলীন করা হবে।
আগেও বলেছিলাম, ইন্ডিয়ায় মুসলমান সংখ্যালঘু বিধায় সেখানে মাজারবিদ্বেষ খুবই কম। মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপস্থিতি, প্রতিনিধিত্ব, প্রতিষ্ঠান— সবই মাজারকেন্দ্রিক। সময়ে সময়ে মাজারকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীও হয়ে উঠে।
অনেক মাজার পরিচালিত হয় ওয়াকফ সম্পত্তির মাধ্যমে। এই সম্পত্তিতে হাত দেওয়ার মাধ্যমে মাজারকেন্দ্রিক মজমা ভেঙ্গে দেওয়া হবে। মুসলমানদের যতটুকু উপস্থিতি ছিল সামাজিকভাবে, সেটাও নিশ্চিহ্ন করা হবে।
প্রান্তিক পর্যায়ের গরীব মুসলমানরা ওয়াকফ বোর্ড থেকে শিক্ষা বৃত্তি পেয়ে থাকে। কিন্তু এই বিলের প্রভাবে আগের মতো বোর্ডের হাতে ক্ষমতা থাকবে না গরীবদের সহযোগিতা করার। ফলে, গরীবদের মধ্য থেকে পড়াশোনা করে উঠে আসা প্রফেসর, ব্যারিস্টার, জজ, পলিটিশিয়ান, স্টেটসম্যানের সংখ্যা দিনদিনই কমতে থাকবে।
আরো বড় কথা, লাখেরাজ সম্পত্তির মতো এখানেও ‘উপযুক্ত সনদ’র কথা বলা হয়েছে। ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালে যদি কেউ ‘উপযুক্ত সনদ’ না দেখাতে পারে তাহলে পুরো ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। ঠিক ইংরেজ নীতিরই ফটোকপি।
আসাদউদ্দিন ওয়াইসি অলরেডি বলেছেন, “ওয়াকফকে সরিয়ে দিয়ে আপনারা ব্যবহারকারীকে নথি (সম্পত্তির সংশ্লিষ্ট) পেশ করতে বলছেন। ৪০০ বছরের পুরানো নথি যদি না থাকে তাহলে কোথা থেকে আনবে তারা?” —বাস্তবতা হলো বেশিরভাগই আনতে পারবে না, ফলত বাজেয়াপ্ত করা হবে সম্পত্তি।
এভাবেই হিন্দুত্ববাদী ভারতের মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। ২০০ বছর আগে, ইংরেজরা যেভাবে লাখেরাজ সম্পত্তির বাজেয়াপ্তির মাধ্যমে মুসলমানদেরকে আঁটকুড়ে বানিয়ে রেখেছিলো, ২০০ বছর পর ঠিক একই কায়দায় হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার ওয়াকফ বিল পাশের মাধ্যমে ইন্ডিয়ার মুসলমানদের কোমর ভেঙ্গে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।
মাঝখানে তফাতটা হলো, ২০০ বছর আগে কোনো পাকিস্তান, বাংলাদেশ ছিল না ; আজকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ— দুইটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আছে যেখানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতের মুসলমানদের এই ভয়াবহ বিপদে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র কি তাদের পাশে দাঁড়াবে?
লেখক: সাহিত্য পত্রিকা মজলিশ সম্পাদক