■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
ইন্টারনেট বা টেলিযোগাযোগ সেবা বন্ধের সুযোগ নিষিদ্ধ করে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) উপদেষ্টা পরিষদের ৫২তম বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে নাগরিকদের গোপনীয়তার সুরক্ষা, রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে জবাবদিহিতা এবং বিটিআরসির স্বাধীনতা পুন:প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
নতুন এই অধ্যাদেশে এনটিএমসি বিলুপ্ত করে ‘সেন্টার ফর ইনফরমেশন সাপোর্ট’ নামে নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেখানে বৈধ ইন্টারসেপশনের ক্ষেত্রে আধা-বিচারিক অনুমোদন ও সংসদীয় তদারকি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে ‘স্পিচ অফেন্স’ সংক্রান্ত নিবর্তনমূলক ধারা সংশোধন করে কেবল সহিংসতার আহ্বানকে অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে।
সংশোধিত অধ্যাদেশের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ সেবার মানবিক মানোন্নয়ন, নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় নজরদারি ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই সংশোধন আন্তর্জাতিক উত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেলিযোগাযোগ খাতকে আরও গণতান্ত্রিক, বিনিয়োগবান্ধব ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণমূলক করে তুলবে।
সংশোধিত আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- ইন্টারনেট বা টেলিযোগাযোগ সেবা কখনোই বন্ধ করা যাবে না। এমন বিধান যুক্ত করা হয়েছে ধারা ৯৭-এর মাধ্যমে। ফলে ভবিষ্যতে কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে দেশব্যাপী বা আংশিকভাবে ইন্টারনেট শাটডাউনের সুযোগ থাকছে না।
একইসঙ্গে ২০১০ সালের বিতর্কিত সংশোধনী কাঠামো থেকে সরে এসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির ক্ষমতা ও কার্যপরিধির মধ্যে ভারসাম্য আনা হয়েছে। আগে যেখানে সব ধরনের লাইসেন্স অনুমোদন মন্ত্রণালয়ের হাতে ছিল, এখন জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লাইসেন্স ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টাডির ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেবে। অন্যান্য সব লাইসেন্স ইস্যুর এখতিয়ার পুনরায় বিটিআরসির কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, আইনমন্ত্রীকে প্রধান করে একটি কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা স্বার্থে আইনানুগ ইন্টারসেপশন সংক্রান্ত অনুমোদন প্রদান এবং সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী কাজ করবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রেস সচিব বলেন, ‘সংশোধিত আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে কোনো পরিস্থিতিতেই বা কোনো অজুহাতেই এক মিনিটের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করা যাবে না। বিগত সময়ে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ইন্টারনেট শাটডাউনের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তা রোধ করতেই এই পদক্ষেপ।’
তিনি বলেন, ‘ফোনে আড়িপাতা ও নজরদারির বিষয়ে বড় সংস্কার আনা হচ্ছে। এতদিন নজরদারির একচ্ছত্র ক্ষমতা নির্দিষ্ট কিছু সংস্থার হাতে থাকলেও, নতুন আইনে তা জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে।’
একই সঙ্গে ব্যক্তিগত উপাত্তের সুরক্ষায় ‘সেন্টার ফর ইনফরমেশন সাপোর্ট (সিআইএস)’ নামে একটি কারিগরি প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শফিকুল আলম বলেন, ‘অধ্যাদেশে সিআইএস নামে একটি কারিগরি প্ল্যাটফর্ম গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জাতীয় উপাত্ত ব্যবস্থাপনা এবং ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনসমূহের মানদণ্ড অনুসরণ করে পরিচালিত হবে। অধ্যাদেশে ল’ মিনিস্টারকে (আইনমন্ত্রী) প্রধান করে একটি কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা স্বার্থে আইনানুগ ইন্টারসেপশন সংক্রান্ত অনুমোদন প্রদান এবং সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী সম্পাদন করবে।
এছাড়া ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির সভাপতিত্বে একটি ‘জবাবদিহিতা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রম তদারকিতে ভূমিকা রাখবে।
লাইসেন্স আবেদন থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময়সীমা কমানো হয়েছে। পাশাপাশি পূর্ববর্তী আইনে বর্ণিত উচ্চ ও পুনরাবৃত্তিমূলক জরিমানা কমানো হয়েছে, যা টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে বলে মনে করছে সরকার।
সংশোধিত আইনে বিটিআরসির স্বচ্ছতা বাড়াতে প্রতি চার মাসে গণশুনানি আয়োজন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব গণশুনানির সিদ্ধান্ত ও ফলোআপ বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট রোধে নির্দিষ্ট বিধান যুক্ত করা হয়েছে (ধারা ৮৭)।
নাগরিকের গোপনীয়তা সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। সিম ও ডিভাইস রেজিস্ট্রেশনের তথ্য ব্যবহার করে কোনো নাগরিককে নজরদারি বা অযথা হয়রানি করলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে (ধারা ৭১)।
বহুল আলোচিত ‘স্পিচ অফেন্স’ সংক্রান্ত নিবর্তনমূলক ধারা পরিবর্তন করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য আনা হয়েছে। এখন থেকে কেবল সহিংসতার আহ্বান অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে (ধারা ৬৬ক)।
টেলিযোগাযোগ সেবায় আপিল ও সালিশ ব্যবস্থাও যুক্ত করা হয়েছে (ধারা ৮২খ), যাতে গ্রাহক ও অপারেটর উভয়ই আইনি প্রতিকার পেতে পারে।
আইনানুগ ইন্টারসেপশন বা বৈধ নজরদারির সংজ্ঞা ও পরিধি এবার স্পষ্টভাবে আইনে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘সেন্টার ফর ইনফর্মেশন সাপোর্ট (সিআইএস)’ প্রতিষ্ঠার বিধান রাখা হয়েছে (ধারা ৯৭ক)। এই কেন্দ্র ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশের মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
জাতীয় নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জরুরি প্রাণরক্ষা, বিচারিক বা তদন্ত কার্যক্রম এবং আন্তঃসীমান্ত বিষয়ে কেবল নির্দিষ্ট ও আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ইন্টারসেপশন করা যাবে। এ ক্ষমতা কেবল আইনে স্পষ্টভাবে বর্ণিত নির্দিষ্ট সংস্থাগুলো নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে প্রয়োগ করতে পারবে।
সিআইএসের মাধ্যমে রোল-বেজড অ্যাক্সেস কন্ট্রোল ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আধা-বিচারিক কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়া কোনো ইন্টারসেপশন পরিচালনা করা যাবে না। নতুন গঠিত সিআইএস নিজে কোনো ইন্টারসেপশন পরিচালনা করবে না। এটি কেবল কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে (ধারা ১৭ক)। ফলে রাজনৈতিক নজরদারি, অপব্যবহার ও ব্ল্যাকমেইলিং বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এই সংশোধনের মাধ্যমে এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটরিং সেন্টার) বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে (ধারা ৯৭)।
আইনানুগ ইন্টারসেপশনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি আধা-বিচারিক কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। কাউন্সিলের কাছে বেআইনি ইন্টারসেপশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা যাবে। এই কাউন্সিলে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী (সভাপতি), প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং স্বরাষ্ট্র সচিব সদস্য হিসেবে থাকবেন।
এছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটি প্রতি বছর আইনানুগ ইন্টারসেপশন বিষয়ে একটি জাতীয় বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এতে ইন্টারসেপশনের ক্ষেত্র, বাজেট ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার তথ্য থাকবে। পাশাপাশি ইমেজ ও ভয়েস প্রোটেকশন, সিম ডেটা ও ডিভাইস ডেটা সুরক্ষার বিধানও যুক্ত করা হয়েছে।
সরকার জানিয়েছে, সংশোধিত এই অধ্যাদেশের আওতায় গৃহীত সব ব্যবস্থাপনা জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নসহ (আইটিইউ) আন্তর্জাতিক উত্তম অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি সরকারি উদ্যোগ ও বেসরকারি অর্থায়নে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) কার্যালয়ে ছোট পরিসরে ‘জাতীয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ বা ‘ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার’ (এনএমসি) নামে সংস্থাটি যাত্রা শুরু করে। ২০১৩ সালের ৩১শে জানুয়ারি এর নাম পরিবর্তন করে ‘ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)’ বা জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রাখা হয়। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এনটিএমসি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে।
স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম শুরুর পর ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংস্থাটির জন্য পদ সৃষ্টি করলে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে ৪৪ জন জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। একই বছরের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইবনে ফজল সায়েখুজ্জামান এনটিএমসির প্রথম পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ডিজিএফআই অফিস থেকে এনএমসি কার্যলয় ঢাকার তেজগাঁও-এ তাদের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। ২০১৭ সালের ৬ই মার্চ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান এনটিএমসি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বর্তমানে এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ওসমান সরোয়ার।
