সুদানে হামলায় হতাহত বাংলাদেশি ১৪ শান্তিরক্ষীর পরিচয়

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■ 

সুদানের আবেইতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেজ-এ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ও আহত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের নাম-পরিচয় জানিয়েছে সেনাবাহিনী। হামলায় ৬ শান্তিরক্ষী নিহত হন এবং ৮ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে একজনের সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে।

রোববার (১৪ ডিসেম্বর) দুপুরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হতাহতদের পরিচয় জানানো হয়।

আইএসপিআর জানায়, সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) স্থানীয় সময় আনুমানিক বেলা ৩টা ৪০ মিনিট থেকে ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক ড্রোন হামলা পরিচালনা করা হয়। এতে দায়িত্বরত ৬ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী শহীদ হন এবং ৮ জন শান্তিরক্ষী আহত হন। 

শহীদ শান্তিরক্ষীদের মধ্যে আছেন

কর্পোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর), সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা (রাজবাড়ি), সৈনিক শান্ত মন্ডল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) ও লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)

আহত শান্তিরক্ষীদের মধ্যে আছেন

লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন, কর্পোরাল আফরোজা পারভিন ইতি, ল্যান্স কর্পোরাল মহিবুল ইসলাম, সৈনিক মো. মেজবাউল কবির, সৈনিক মোসা. উম্মে হানি আক্তার, সৈনিক চুমকি আক্তার, অর্ডন্যান্স ও সৈনিক মো. মানাজির আহসান।

আইএসপিআর জানায়, আহত ৮ জন শান্তিরক্ষীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে সৈনিক মো. মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ইতোমধ্যে তার সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। অপর আহত ৭ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারযোগে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং তারা সবাই শঙ্কামুক্ত রয়েছেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। শহীদ শান্তিরক্ষীদের আত্মত্যাগ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারের এক উজ্জ্বল ও গৌরবময় নিদর্শন হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হচ্ছে এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে আইএসপিআর।

পাকুন্দিয়ার জাহাঙ্গীরের বাড়িতে মাতম

সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে সন্ত্রাসী ড্রোন হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী শহীদ হয়েছেন এবং আটজন আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের (৩০) বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামে। তিনি মো. হজরত আলী রহমানের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীর দ্বিতীয়। তাঁর বড় ভাই মোস্তফা কামাল সৌদিপ্রবাসী। ছোট ভাই শাহীন আলম গাড়িচালক। সন্ত্রাসীদের হামলায় জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে দায়িত্বরত সৈনিক জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুর খবর জানার পর তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলছে মাতম।

নিহত জাহাঙ্গীরের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের অক্টোবরে জাহাঙ্গীর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) রাতে সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আটজন। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ চলমান রয়েছে।

নিহত জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই আরিফুর ইসলাম বাধন বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) রাতে আমার ফুফাতো ভাই ও জাহাঙ্গীরের সহকর্মী মনির হোসেন এবং ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইমরান টেলিফোনে ঘটনাটি জানান। এর পর থেকে পরিবারের কান্না থামছে না। বৃদ্ধ বাবা হজরত আলী বাক্‌রুদ্ধ।’

আরিফুর ইসলাম আরও বলেন, ‘জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার স্বামীর ছবি ও তিন বছরের ছেলে ইফরানকে বুকে আঁকড়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। মাঝেমধ্যে চিৎকার করে কেঁদে উঠছেন।’

নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মামা ওয়ালিউল্লাহ বলেন, ‘অফিশিয়ালি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন ইমরান আমাদের বিষয়টা জানান। এর আগে গতকাল (শনিবার) রাতে আমাদের আত্মীয়স্বজন জানান যে জাহাঙ্গীর মারা গেছে।’

জাহাঙ্গীর আলমের ছোট ভাই মো. শাহীন বলেন, ‘রাত দেড়টায় বাসায় ফিরে দেখি সবাই কান্নাকাটি করছে। পরে জানতে পারি, আমার ভাই বোমা হামলায় মারা গেছে।’ এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহীন।

নিহত জাহাঙ্গীর আলমের বাবা হজরত আলী রহমান বলেন, ‘রাতে আমার এক ভাই ফোন দিয়ে বলছে সুদানে বোমা ফুটছে। পরে আমি বাড়িতে আইসা বলি, জাহাঙ্গীর যেহানো থাহে, ওইহানো বোমা ফুটছে বুলে। পরে শুনছি, বোম ফালাইয়া আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে। আমার ছেলে যেখানে থাকত, এর থেকে একটু দূরে যারা থাকত, তারা রাতে জানাইছে।’

এই খবর আসার পর থেকে জাহাঙ্গীরের পরিবারে চলছে মাতম। জাহাঙ্গীরের পরিবার মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে।

পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুপম দাস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মরদেহ কীভাবে আনা হবে, এ ব্যাপারে কোনো সরকারি নির্দেশনা এখনো পাইনি। আমরা যোগাযোগ রাখছি।’

সুদানে হামলায় শহীদ শামীম বলেছিল আব্বা তুমি ভালো থাকো

সুদানের আবেই এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন। শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গী গ্রামের শামীম রেজা (২৮)।

নিহত শামীম রেজা হোগলাডাঙ্গী গ্রামের আলমগীর ফকিরের বড় ছেলে। গত ৭ নভেম্বর সুদানের আবেইতে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন।

রোববার (১৪ ডিসেম্বর) বিকেলে শামীম রেজার পরিবারসহ পুরো গ্রাম শোকে স্তব্ধ।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় হোগলাডাঙ্গী কামিল মাদরাসা ছাত্র ছিলেন শামীম রেজা। তিনি এই মাদরাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করেন। পরে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ তার কর্মস্থল ছিল বগুরা সেনানিবাসে। চার ভাই-বোনের মধ্যে শামীম রেজা ছিলেন সবার বড়। গ্রামে তারা বাবা, মামা, স্ত্রী, ছোট ভাই ও বোন থাকেন। তার বাবা স্থানীয় একটি মসজিদের মোয়াজ্জেম। গত দেড় বছর আগে বিয়ে করেন শামীম। প্রায় ৮ বছরের ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি। শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের স্বপ্ন নিয়ে বাবা, মা, স্ত্রী ও ছোট ভাই বোনকে রেখে গত ৭ নভেম্বর সুদানে যান তিনি।

নিহত শামীম রেজার ছোট ভাই সোহান ফকির বলেন, ভাইয়া ৮ বছর ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করে। গত ৭ নভেম্বর সুদানে শান্তিরক্ষা মিশনে যায় সে। গতকাল রাত ১২টার দিকে আমরা তার নিহতের খবর পাই। পরে জানতে পারি ড্রোন হামলায় সে নিহত হয়। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আগামী পরশু দিন আমার ভাইয়ের মরদেহ দেশে আসতে পারে।

নিহত শামীম রেজার বাবা আলমগীর ফকির বলেন, আমি কৃষিকাজ করে শামীমকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলাম। ৮ বছর আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় শামীম। গত ৭ নভেম্বর আমি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যাই। সর্বশেষ গত শুক্রবার ছেলের সঙ্গে আমার মোবাইল ফোনে ভিডিও কলে কথা হয়। বললাম মুনি কেমন আছো, তোমার চোখ ফুলে গেছে কেন। সে বলল ঘুমায় ছিলাম বাবা। তখন আমার ছেলে বলল, আব্বা তুমি ভালো থাকো। আমি ডিউটিতে যাব। ওই ছিল শেষ কথা। ডিউটিতে গিয়ে আর ফিরল না আমার ছেলেটা। শনিবার রাত ১২টার দিকে আমরা খবর পাই আমার ছেলে আর নেই।

তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে শামীম দেড় বছর আগে কুষ্টিয়ার খোকসায় বিয়ে করে। শামীমের স্বপ্ন ছিল ছোট ভাই-বোনদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে। সে আমার মেঝ ছেলেকে সৌদি আরব পাঠিয়েছে। ছোট ছেলেকে সিঙ্গাপুর পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করেছে। মিশন থেকে ফেরার সময় একমাত্র বোনের জন্য সোনার গহনা নিয়ে আসতে চেয়েছিল। সব স্বপ্নই এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল।

মৃগী ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য মোস্তফা কামাল বলেন, শামীম রেজা খুবই একজন ছেলে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল রাতে সুদানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন তিনি। আমরা চাই দ্রুত তার মরদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

এদিকে বিকেল ৪টার দিকে রাজবাড়ী সদর সেনা ক্যাম্পের একটি দল শামীম রেজার গ্রামের বাড়িতে তার পরিবারের খোঁজখবর নিতে আসে। এসময় তারা শোকসন্তপ্ত শামীমের পরিবারকে সান্ত্বনা ও সমবেদনা জানান।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *