দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহ নিবন্ধন ফিরে পেল জামায়াত

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■ 

জামায়াতে ইসলামীর জন্য তাঁদের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ পুনরায় বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে দলটিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে নিবন্ধন। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেল দলটি।

মঙ্গলবার (২৪ জুন) নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে জামায়াতকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহ নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়।

প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, ‘যেহেতু রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার, ১৯৭২ এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য এ আদেশের আর্টিকেল ৯০বি এর শর্তানুযায়ী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামীয় দল কর্তৃক নিবন্ধনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামীয় দলকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ৫ নভেম্বর ২০০৮/২১ কার্তিক ১৪১৫ তারিখের নিকস/প্র-৩/রাদ/৫(৪৪)/২০০৮/১১৪১ সংখ্যক প্রজ্ঞাপনমূলে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল (নিবন্ধন নম্বর-০১৪, তারিখ : ৪ নভেম্বর ২০০৮); এবং যেহেতু, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশন নম্বর-৬৩০ অব ২০০৯ এর প্রদত্ত রায়ের সূত্রে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ১৩ কার্তিক ১৪২৫/২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখের প্রজ্ঞাপনমূলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়।’

‘যেহেতু, সিভিল আপিল নং ১৩৯ অব ২০১৩ উইথ সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং ৩১১২ অব ২০১৩ এ আপিল বিভাগ কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশন নম্বর-৬৩০ অব ২০০৯ এর প্রদত্ত রায় বাতিলপূর্বক দলটির নিবন্ধন পুনর্বহালের আদেশ দিয়েছে; সেহেতু, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিভিল আপিল নং ১৩৯ অব ২০১৩ উইথ সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং ৩১১২ অব ২০১৩ এর প্রদত্ত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামীয় দলের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখের প্রজ্ঞাপনটি এতদ্বারা বাতিলক্রমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন দলীয় প্রতীকসহ পুনর্বহাল করা হলো।’

এর আগে, গত ১ জুন রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে জামায়াতের দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সিদ্ধান্ত নেবে বলে আপিল বিভাগের আদেশে বলা হয়।

বর্তমানে সংসদের জন্য ৬৯টি দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতীক রয়েছে। ইসি সচিবালয় থেকে নতুন কিছু প্রতীকসহ সব মিলিয়ে ১১৫টি প্রস্তাব রয়েছে। কমিশন পযালোচনা করে শিগগির প্রতীক চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।

২০১৩ সালে আদালত দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রথমে রায় দেয়। এর তিন বছর পর ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে এবং কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

এরপর তারপর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে জামায়াতের জন্য বরাদ্দ মার্কা দাঁড়িপাল্লা নির্বাচনি প্রতীকের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ২০১৭ সালের ৮ মার্চ গেজেট জারি করে ইসি। এক যুগ পর গত ১ জুন আপিল বিভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের যে রায় হাই কোর্ট দিয়েছিল তা বাতিল করে দেয়।

সর্বোচ্চ আদালত ১ জুন আদেশে বলেছিল, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

আদালতের আদেশের পর জামায়াতের নিবন্ধন ও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ফেরত দেওয়ার বিষয়ে কোরবানির ঈদের আগে ৪ জুন কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন।

সভা শেষে সেদিন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত দলীয় নিবন্ধন ও প্রতীক ফেরত পাবে। তবে দলীয় প্রতীকটি ফেরতের ক্ষেত্রে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগবে।

এর তিন সপ্তাহের মাথায় প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করল ইসি সচিবালয়।

বর্তমানে নিবন্ধিত দল রয়েছে ৫০টি। আরও অন্তত ১৪৭টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।

২০০৮ সালের নভেম্বরে জামায়াতকে নিবন্ধন সনদ দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে ইসির দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট করেন সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি।

চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ। একই সঙ্গে আদালত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সনদ দেন, যা ওই বছরই আপিল হিসেবে রূপান্তরিত হয়। পাশাপাশি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে দলটি।

হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পরপরই তা স্থগিত চেয়ে জামায়াত আবেদন করে, যা ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের তৎকালীন চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এরপর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

জামায়াতে ইসলামীকে দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দলটির করা আপিল ও লিভ টু আপিল ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর খারিজ করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। আপিলকারীর পক্ষে সেদিন কোনো আইনজীবী না থাকায় আপিল বিভাগ ওই আদেশ (ডিসমিসড ফর ডিফল্ট) দেন।

পরে দেরি মার্জনা করে আপিল ও লিভ টু আপিল পুনরুজ্জীবিত চেয়ে দলটির পক্ষ থেকে পৃথক আবেদন করা হয়। শুনানি নিয়ে গত বছরের ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ আবেদন মঞ্জুর (রিস্টোর) করে আদেশ দেন।

এরপর জামায়াতের আপিল ও লিভ টু আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। গত ৩ ডিসেম্বর শুনানি শুরু হয়। আর প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে দলটি একটি আবেদন করে, যা গত ১২ মে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে ওঠে। সেদিন আদালত আপিল ও লিভ টু আপিলের সঙ্গে শুনানির জন্য আবেদনটি ট্যাগ (একসঙ্গে) করে দেন। আগের ধারাবাহিকতায় শুনানি শেষে ১ জুন রায় দেন আপিল বিভাগ।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত বছরের ১ আগস্ট জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে জারি করা আগের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *