আনিসুল, হাওলাদার ও চুন্নুর নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে জাপা

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

জাতীয় পার্টি এখন দুই পক্ষে বিভক্ত। এক পক্ষে আছেন দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) ও তাঁর অনুসারীরা, অন্য পক্ষে রয়েছেন দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ শীর্ষ নেতাদের একটি অংশ।

জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, ২৮ জুন বাংলাদেশ-চীন-মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে দলটির দশম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই মিলনায়তনটি বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে ১৬ জুন সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করেন জি এম কাদের। চেয়ারম্যানের এ সিদ্ধান্তে বেশ চটে যান দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। একপর্যায়ে তাঁরা দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইলে আলাদা সম্মেলন আহ্বান করেন। পরে জি এম কাদেরের অনুসারীরা সেখানে সমাবেশ করার ঘোষণা দিলে সংঘাত এড়াতে আপাতত কাউন্সিল না করার সিদ্ধান্ত নেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এসব ঘটনায় দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে।

দলের গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা চেয়ারম্যানকে এমন ক্ষমতা দিয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি যেকোনো নেতাকে বহিষ্কার বা পদচ্যুত করতে পারেন, আবার পদোন্নতিও দিতে পারেন। এ কারণে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বে জ্যেষ্ঠ নেতারা এ ধারার বিলোপ এবং প্রেসিডিয়ামের ক্ষমতা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারম্যান এ ধারার অপপ্রয়োগ করছেন বলে অভিযোগ নেতাদের।

দলটির সঙ্গে জড়িত একাধিক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই জি এম কাদেরের নেতৃত্বশৈলী দলে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রেসিডিয়ামের সম্মতি ছাড়াই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া, দলের গণতান্ত্রিক চর্চা ক্ষুণ্ন করা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এসব কারণে দলের অধিকাংশ নেতা চেয়ারম্যানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির ঘনিষ্ঠতা এবং জি এম কাদেরের অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী অবস্থান দলকে রাজনৈতিকভাবে আরও কোণঠাসা করে তুলেছে বলে মনে করেন নেতারা।

দলে নেতৃত্বের পরিবর্তনের পক্ষে থাকা নেতারা বলছেন, ইতিমধ্যে জি এম কাদেরসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে। জি এম কাদের নেতৃত্বে থাকলে সামনে দলের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিতে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। তাই জি এম কাদেরকে বাইরে রেখে দলের নেতৃত্ব তৈরির চেষ্টা করছেন তাঁরা।

দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, ২০-এর ‘ক’ যদি গঠনতন্ত্রে থাকে তাহলে পার্টি নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হয়। উনার (চেয়ারম্যান) বিপক্ষে যে কথা বলবে তাঁকে বের করে দেবে, কারও কোনো অনুমোদন নেওয়ার দরকার নেই, এভাবে পার্টি করা যায় না। এই যে রাজার ক্ষমতা, এইটা আমরা পরিবর্তন করতে বলেছিলাম। এ ছাড়া ফাইন্যান্সিয়াল ট্রান্সপারেন্সির (আর্থিক স্বচ্ছতা) এবং দলে বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলেছি। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে একমত হননি।’

বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে জি এম কাদের রাজি নন জানিয়ে আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘উনি আমাদেরকে নিয়ে বসবেন না। সম্মেলন ডাকার পর প্রেসিডিয়াম পাল্লা ভারী করতে তিনি ওখানে সাতজনকে অলরেডি বের করেছেন। তাঁর পক্ষের পাঁচজনকে নিয়েছেন। এভাবে উনি কোরাম করার চেষ্টা করছেন। একটা মেজরিটি করার চেষ্টা করছেন।’

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘চেয়ারম্যানের সম্মতি ছাড়া কাউন্সিলের কোনো স্থান কখনো নির্ধারণ করা যাবে না। এটা আমাদের গঠনতন্ত্রে আছে। আর কাউন্সিল মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করবেন চেয়ারম্যান। এটাও আমাদের গঠনতন্ত্রে আছে। এসব বিষয়ে আলোচনা হয়নি। আমরা সামনে আবার মিটিং ডাকব এবং আবার কাউন্সিলের ব্যাপারে আলাপ করব। পাশাপাশি আমাদের হলরুম পাওয়া সাপেক্ষে নিরাপত্তার কোনো সমস্যা যদি না থাকে, আমরা অবশ্যই স্বল্প সময়ে কাউন্সিল করতে আগ্রহী।’

গঠনতন্ত্রের ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ ধারা প্রসঙ্গে এই জাপা নেতা বলেন, এ রকম একটি ধারা অনেক দিন আগে থেকেই আছে, এ ধারার অধীনে যে খুব বেশি কাজ হয়, এমনটিও নয়। যদি জরুরি অবস্থায় প্রেসিডিয়াম মিটিং করা না যায় সে ক্ষেত্রে এই ‘এক্সেপশনাল সেফটিনেস পাওয়ারটা’ চেয়ারম্যানের কাছে আছে, যেটা খুব কমই ব্যবহার করা হয়।

এদিকে জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবদের সঙ্গে জরুরি সভায় ছিলেন না দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, ‘সেই মিটিংয়ে আসলে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে আমি জানি না, আমি মিটিংয়ে ছিলাম না। আমার দেখামতে দলে কোনো বিশৃঙ্খলা আমি দেখতে পাই না। তাঁরা (অন্যা নেতারা) বরং চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছেন প্রেসিডিয়াম মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে যাতে কাউন্সিলটা করা হয়। এটা তো আর বিশৃঙ্খল নয়, এটা তো অধিকার। কাউন্সিল যে সময় হবে, তাঁরা সে সময় অনুযায়ী কাউন্সিলের জন্য দাবি জানাইছেন। এটাকে যদি উনি (চেয়ারম্যান) বিশৃঙ্খলা হিসেবে নেন, এটা উনার বিষয়, নিতে পারেন।’

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *