■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
নারায়ণগঞ্জ জেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নে মেঘনা নদী থেকে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার (২২ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টার দিকে মুন্সিগঞ্জের মেঘনা নদী থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে নৌ-পুলিশের সদস্যরা। তিনি দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’র জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
শুক্রবার সকালে ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে শেষ লেখায় নিজের ও ছেলের অসুস্থতা, মেডিকেল পাস সরকারি কর্মকর্তা মেয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় ‘ফেল করা’, বুয়েটে থেকে পাস করা ছেলের ‘চাকরি না হওয়া’ এবং নিজের আর্থিক দৈন্য নিয়ে হতাশার কথা লিখে গেছেন বিভুরঞ্জন।
এরই মধ্যে তার মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশের পাঠানো একটি ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) সকাল ১০টায় অফিসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। তবে পরিবারের সদস্যরা জানান, তিনি তার মোবাইল ফোন বাসায় ফেলে গেছেন। কিন্তু তিনি ওই দিন অফিসেও যান নি। এমনকি পরিচিত পরিমণ্ডলেরও কোথাও যাননি। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে বৃহস্পতিবার রাতে রমনা থানায় নিখোঁজ সংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়।
পুলিশের পাঠানো ছবিতে দেখা গেছে, তার পরনে একটি প্রিন্টের হাফ হাতা শার্ট, এবং সোনালী রঙের চশমাটি গলায় ছিল। নিচের অংশে শুধু অন্তর্বাস পরা ছিল। তবে ছবিতে কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি।
নৌ–পুলিশের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন জানান, মৃতদেহ দেখে ধারণা করা হচ্ছে একদিন আগে তার মৃত্যু হয়। মৃতদেহ কিছুটা বিকৃত হতে শুরু করেছে। দেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। ময়নাতদন্তে তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে তিনি বাসা থেকে বের হন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মেলেনি। এ বিষয়ে রাজধানীর রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে কর্মস্থল বনশ্রীর আজকের পত্রিকা কার্যালয়ে যাওয়ার কথা বলে তিনি বাসা থেকে বের হন। যদিও পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তিনি সেখানে যাননি। তিনি মোবাইল ফোনটিও বাসায় ফেলে যান।
আজকের পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, ১৬ আগস্ট থেকে সাত দিনের ছুটিতে ছিলেন বিভুরঞ্জন।
বিভুরঞ্জন সরকারের ভাই চিররঞ্জন সরকার বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে লেখেন, আমার দাদা সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় অন্যান্য দিনের মতো অফিস (আজকের পত্রিকা) যাবেন বলে বাসা থেকে বের হন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি অফিসে যাননি। পরিচিত পরিমণ্ডলের কোথাও যাননি। আজ কেউ তাকে দেখেননি। রাত ১টা পর্যন্ত বাসায় ফেরেননি।
পরিবার জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বিভুরঞ্জন তার মোবাইল ফোনটিও বাসায় রেখে গিয়েছিলেন।
তিনি না ফেরায় এবং কারো কাছে তার কোনো তথ্য না পাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার ছেলে ঋত সরকার।
সেখানে তিনি বলেন, প্রতিদিনের মত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য রওনা করেন তার বাবা। কিন্তু এরপর আর বাসায় ফেরেননি।
“আমরা বাবার অফিসে (বনশ্রী) খোঁজ নিই এবং জানতে পারি যে তিনি অফিসে উপস্থিত হননি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সম্ভাব্য সকল স্থানে অনেক খোঁজাখুঁজি করি। কিন্তু কোথাও পাওয়া না গেলে থানায় এসে সাধারণ ডায়েরির আবেদন করলাম।”
“পরিচিত পরিমণ্ডলের কোথাও যায়নি। আজ কেউ তাকে দেখেনি। রাত ১টা পর্যন্ত সে বাসায় ফেরেনি। হাসপাতাল-পার্ক কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে আজ মোবাইলও বাসায় রেখে গেছে। রাতে রমনা থানায় জিডি করা হয়েছে। তার জন্য আমরা পরিবারের সবাই ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে আছি।”
যোগাযোগ করা হলে রমনা থানার ওসি গোলাম ফারুক শুক্রবার সকালে বলেছিলেন, “আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। তবে উনি ফোনটা বাসায় রেখে গেছেন। ফোনটা সাথে থাকলে হয়তো খুঁজে পেতে সুবিধা হত।”
এরপর বিকালে মুন্সীগঞ্জে বিভুরঞ্জনের লাশ পাওয়ার খবর জানায় পুলিশ।
রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম বলেন, ‘মেঘনা নদীতে পাওয়া লাশ যে বিভুরঞ্জন সরকারের, তা আমরা নিশ্চিত হয়েছি। পরিবারের সদস্যরা শনাক্ত করার পর আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। তিনি বাসা থেকে বের হওয়ার পর কী ঘটেছিল, তা জানার জন্য আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা হচ্ছে।’
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ষাটের দশকে, তখন তিনি স্কুলের ছাত্র। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে তাঁর হাতেখড়ি। এরপর প্রায় পাঁচ দশক ধরে দেশের বিভিন্ন শীর্ষ পত্রিকা ও সাপ্তাহিকে কাজ করেছেন তিনি। সাপ্তাহিক যায়যায়দিন, সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক রূপালী, দৈনিক সংবাদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক চলতিপত্র। নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন মৃদুভাষণে এবং সম্পাদনা করেছেন দৈনিক মাতৃভূমি। দেশের প্রায় সব বড় পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে নিয়মিত। একাধিক বইও লিখেছেন তিনি।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ১০ মার্চ তিনি আজকের পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। পরে ২০২২ সালের ১ জুলাই পদোন্নতি পেয়ে জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক হন।
১৯৫৪ সালে জন্ম নেওয়া বিভুরঞ্জন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে গেছেন। তাঁর মেয়ে চিকিৎসক এবং ছেলে বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলী। ষাটের দশকের শেষ দিকে স্কুলে পড়ার সময় দৈনিক আজাদ-এর মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে লেখাপড়া করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে ‘তারিখ ইব্রাহিম’ ছদ্মনামে লেখা তার রাজনৈতিক নিবন্ধ পাঠকপ্রিয় হয়ল।
ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিম কর্মী ছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন।
তার তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘বৃত্তবন্দি রাজনীতি’, ‘দোষারোপের রাজনীতি’, ‘আওয়ামী লীগ নিয়ে আশা ও আশঙ্কা’, ‘নানা চিন্তা নানা মত’, ‘কার চেয়ে কে ভালো’। তার সম্পাদিত গ্রন্থের তালিকায় রয়েছে- ‘কিবরিয়া স্মারকগ্রন্থ বক্তৃতা’, ‘কৃষক নেতা হাতেম আলী খান’, ‘মোনায়েম সরকার যখন নির্বাসনে’।