■ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ■
অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার।
শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে সাংবাদিকদের ডেকে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
এর ফলে, পাঁচটি প্যানেল ও বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন বর্জনের মধ্যে মোট চারজন শিক্ষক নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ালেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার ভোটের দিন নির্বাচন নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম ও অধ্যাপক শামিমা সুলতানা।
জাকসু কেন্দ্রে ভোটের চেয়ে ব্যালট বেশি যাওয়া, প্রতিপক্ষের আচরণবিধি ভঙ্গ করা, জামায়াত সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন সরবরাহ করা, পোলিং এজেন্টের অনুমতি থাকলেও তাদের প্রবেশে বাধা দেওয়া, ডোপটেস্টের ফলাফল না আসা, নির্বাচনকে ‘ম্যানিপুলেট’ করার নানা অভিযোগ আসছিল।
ভোট গ্রহণের পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো জাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়নি। দ্রুত ফল ঘোষণার দাবিতে শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে জাকসুর সিনেট ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা৷
অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে গতকাল অনেক ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আগেও আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছি। সেই তথ্যগুলোকে আমি সবসময় মনে করেছি একজন শিক্ষক হিসেবে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নির্বাচন কমিশনে আমার মতামত তুলে ধরে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করা।’
‘আমি আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাকে বিভিন্নভাবে অনেকেই প্রশংসা করলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যখন আমি কোনো মতামত দিয়েছি অথবা আমি কোনো বিষয় তুলে ধরেছি, তখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তা বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। দায়িত্ববান হিসেবে আর ডিটেইলস কিছু বলব না,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আজ বিকেলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সভা ডেকেছিলেন। আমরা দীর্ঘক্ষণ সভা করেছি। এক পর্যায়ে যখন আমি উঠে নামাজ পড়তে গিয়েছি, এসে দেখেছি ভোট গণনা শুরু হয়ে গেছে। আমি নির্বাচন কমিশনকে বারবার অনুরোধ করেছি যে, অভিযোগগুলো সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে আপাতত গণনা স্থগিত রাখা হোক, সুষ্ঠু স্বচ্ছ জাকসুর দিকে এগিয়ে যাই। কিন্তু আমি তাতে ব্যর্থ রয়েছি।’
‘আমি অনেকগুলো অনিয়ম দেখেছি, মারাত্মক ত্রুটি দেখেছি, যে ত্রুটিগুলো পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আমার মতামত গ্রহণে অপরাগতা প্রকাশ করেছে। যখন দেখছি আমার মতামতের বিষয়ে সুরাহা না করেই ভোট গণনা শুরু হয়ে গেছে, তখন আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।
অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার বলেন, ‘আমি চাপের মুখে পদত্যাগ করিনি, আমাকে বরং চাপ দেওয়া হয়েছে যেন আমি পদত্যাগ না করি। এমনকি বিভিন্নভাবে আমাকে চাপ দেওয়া হয়েছে যেন আমি মেনে নেই। আমি কখনো কাউকে ভয় করিনি, এখনো করব না। আমার কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে, আমি সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি…আমি কোনো দায় নেবো না।’
পদত্যাগের কারণ বলতে গিয়ে অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার বলেন, নির্বাচনে অনেকগুলো মারাত্মক ত্রুটি তিনি দেখেছেন। সেইসব ত্রুটি সংশোধনে তিনি নির্বাচন কমিশনকে যেসব পরামর্শ বা মতামত দিয়েছেন সেগুলোকে রাখা হয়নি। তাকে বৃহস্পতিবার থেকেই চাপ দেওয়া হচ্ছে তিনি যেন নির্বাচন কমিশন থেকে পদত্যাগ না করে সব কিছু মেনে নেন। নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক ছিল না এবং সেখানে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না বলেও জানান তিনি।
মাফরুহী সাত্তার বলেন, “নির্বাচন কমিশনে আমার মতামত তুলে ধরে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। যখন আমি কোনো মতামত দিয়েছি বা তুলে ধরেছি তখন তা বিভিন্নভাবে বা বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন করা হয়েছে।
“৩৩ বছর পরে একটি জাকসু নির্বাচন হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ফলাফলটা চাচ্ছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এই সমগ্র প্রক্রিয়া যেভাবে বিতর্কিত করা হয়েছে, যেভাবে প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করা হয়েছে এবং সর্বশেষ এই ত্রুটিগুলো দূর করার জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হযেছে তার কোনোটাই গ্রহণ করা হয়নি।”
নিজের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে এই অধ্যাপক বলেন, “আজ বিকাল ৪টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সভা ডাকেন। এক পর্যায়ে আমি আসরের নামাজ পড়তে গেলাম। এসে দেখি ভোট গণনা শুরু হয়ে গেছে। আমি কমিশনকে বারবার বলেছি যে, যে অভিযোগগুলো উত্থাপন হয়েছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে আপাতত গণনা বন্ধ রাখা হোক। শিক্ষার্থীসহ সারাদেশ যে সুষ্ঠু স্বচ্ছ জাকসু চেয়েছিল আমরা সেদিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি সেটাতে ব্যর্থ হয়েছি।
“আমি নির্বাচনে অনেকগুলো মারাত্মক ত্রুটি দেখেছি। যেগুলো আসলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এরকম পরিস্থিতিতে আমি, নির্বাচন কমিশনের সকলে এই বিষয়ে একমত হলেও বিশেষ কিছু কারণে তারা আমার যে মতামত সেটাকে গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। সে কারণে আমি যখন আসরের নামাজ পড়ে এসে দেখেছি আমার মতামত সুরাহা না করেই গণনা শুরু হয়ে গেছে তখন আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আমার দ্বিমত লিখিতভাবে জানিয়েছি।”
আপনি নির্বাচনের অনেক পরে এসে কেন এমন কথা বলছেন জানতে চাইলে এই অধ্যাপক বলেন, “আমরা সবাই মানুষ, আমাদের সবার আশা থাকে। যখন সেই জায়গাটা চলে যায়… । আগামীকাল বা পরশু ফল প্রকাশের পরে বললে আপনারা হয়তো বলতেন ফল প্রকাশের পর কেন বললেন।”
সুনির্দিষ্ট কী কারণে বা কোন ত্রুটি সংশোধন না করতে পেরে তিনি পদত্যাগ করলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনই তিনি এসব বলতে চান না। ভবিষ্যতে সময়-সুযোগ পেলে বলবেন।
এবারে জাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ভোটার ৫ হাজার ৭২৮ জন এবং ছাত্র ভোটার ৬ হাজার ১৫ জন। নির্বাচনে ২৫টি পদে মোট ১৭৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।