■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকেলে এই খসড়া ঘোষণাপত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
প্রেস উইং বলেছে, ‘অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। আগামী মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট বিকেল ৫টায় গণঅভ্যুত্থানের সকল পক্ষের উপস্থিতিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত অবিলম্বে ঘোষণা করা হবে।’
এর আগে, গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টায় ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জানান, জুলাই ঘোষণাপত্র এখন ‘বাস্তবতা।’ তিনিও জানান, আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে।
মাহফুজ আলম তাঁর পোস্টে লিখেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র এখন বাস্তবতা। ৫ আগস্টের মধ্যেই ঘোষিত হবে ঘোষণাপত্র। ঘোষণাপত্র ইস্যুকে গণআকাঙ্ক্ষায় বাঁচিয়ে রেখে এটা বাস্তবায়নের পথ সুগম করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার মূল ম্যান্ডেট হলো—রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার এবং জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ। এই প্রেক্ষাপটে জুলাই ঘোষণাপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। খসড়ার অনুলিপি প্রধান তিন রাজনৈতিক দল—বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) পাঠানো হয়েছে তাদের মতামত দেওয়ার জন্য। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আগস্টের ৫ তারিখের মধ্যে যে কোনো দিন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এটি প্রকাশ করবেন।
যেকোনো ধরনের বিতর্ক এড়াতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে প্রণীত খসড়া ঘোষণাপত্রে ২৬টি দফা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে। প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা আসার পর টানা তিন মেয়াদের ১৫ বছরের শাসনামলে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, বিএনপির মতামতের ভিত্তিতে ৭৫-এর ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লব, ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের করা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষে বৃহস্পতিবার কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হবে। এরপর তা দলগুলোকে দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কমিশন দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেছে। এ ক্ষেত্রে কমিশন অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করবে। এর বাইরেও যতটুকু প্রয়োজন, সবাইকে সমন্বিত করে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। তার আগে জাতীয় সনদকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া দরকার। আগামী কয়েক দিন কমিশন সে কাজ করবে। তারপর বাস্তবায়নের পথ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে।
‘জুলাই জাতীয় সনদ’ খুব দ্রুতই হবে বলে আশাবাদী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘এটি যখনই চূড়ান্ত হয়ে আমাদের কাছে আসবে, আমরা স্বাক্ষর করব। এই সনদ যেন বাস্তবায়িত হয়, সেই জন্য আমরা জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে সালাহউদ্দিন আহমদ বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামের এক কর্মসূচিতেও জুলাই সনদ নিয়ে কথা বলেন। জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই সনদে যেসব সুপারিশ থাকবে, সেগুলো দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে বলে সব রাজনৈতিক দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটা বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের যেসব সংশোধনী প্রয়োজন হবে, সেগুলো আমরা করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।’
সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনা এবং তাতে সব ঘরানার দলের উপস্থিতিকে খুবই ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তবে তিনি মনে করেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে, এর বাস্তবায়ন কীভাবে ও কখন হবে, এ বিষয়ে বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের অসহায়ত্ব প্রকাশ পুরো প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে দেবে। কারণ, শুধু পরামর্শের জন্য এত আলোচনার দরকার ছিল না।
জামায়াতের পক্ষ থেকে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া এই নেতা আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া যায়। এটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, অধ্যাদেশ, গণভোট বা ফরমান জারির মাধ্যমে হতে পারে। এই সংস্কারের মাধ্যমেই আগামী নির্বাচন হওয়া দরকার, এটাই আমাদের দাবি।’
জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গতকাল বলেন, ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (আইনগত কাঠামো আদেশ), গণপরিষদ নির্বাচন অথবা গণভোট—যেকোনো পদ্ধতিতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। কোন পদ্ধতিতে সেটি হবে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যেতে পারে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই।’
এনসিপির এই নেতা আরও বলেন, ‘বিএনপি বলছে, তারা এটাকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে, সাংবিধানিক স্বীকৃতি নয়। অর্থাৎ, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি তারা দিতে চাচ্ছে না। আইনি ভিত্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব কি না, সেটা পুনর্বিবেচনা করব।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শেষে জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে গতকাল শুক্রবার পর্যালোচনা বৈঠক করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলের মহাসচিব মাওলানা ইউনূছ আহমাদের সভাপতিত্বে বৈঠকে সংসদের নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) বিষয়টি ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার এজেন্ডায় না রাখায় নিন্দা জানানো হয়।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিশনগুলোর মধ্যে ছয়টি কমিশনের ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে (২০ মার্চ-১৯ মে) দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করে কমিশন। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি, এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ৩ জুন থেকে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন, যা গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়। ২৩ দিনের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় মৌলিক সংস্কারের ১৯টি প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ৮টি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। বাকি ১২টিতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত বা মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে।