:: মেহরাব খান মুন ::
কাজল আরেফিন অমি নামে এক পরিচালকের নাটক দেখা হয়েছে আমার বেশ কিছু। এদের নাটক আমি আসলে নাটক দেখছি এই হিসেবে দেখিনা। দেখি, কিসের নাটক বানিয়েছে সেই হিসেবে । তো, হিসেব কখনোই মেলেনা আমার। শেষে ফলশূন্য হয়েই আমাকে সবসময় অন্যকোথাও মননিবেশ করতে হয়। কিছু কিছু নাটক ভালো থাকে। তবে, দেখি যে সেগুলোর ভিউ কম। ব্যবসা সফল নয়। তার মানে, আমার মতো দর্শক এদেশে আসলেই ক্ষয়িষ্ণু। দোষ যে দিচ্ছি, এই দোষ এখন তাই আমাদেরই।
তারপরও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নিয়ে এই পরিচালকের কয়েকটা নাটক পর্যালোচনা করে একটি বিষয় প্রসঙ্গে কয়টা কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করছি।
কাজল আরেফিন ওমি তার সব কয়টা নাটকে মহিলা চরিত্রগুলোকে ছোট করে দেখায়। তার নাটক মানেই এই দেশের মেয়েরা লোভী, চালবাজ , স্বার্থপর, ছেলেবাজ, এইমলেস , শেইমলেস এবং দুশ্চরিত্র ।
তার নাটকে আজ পর্যন্ত একটা চরিত্র আমি পাইনি যেখানে মেয়েরা সম্মানী কোন স্ক্রীপ্ট পেয়েছে। বা অবস্থান পেয়েছে। ব্যাচেলর পয়েন্ট দিয়ে শুরু করি। সেখানে অদেখা একটা ফিমেল , কাবিলার প্রেমিকা রোকেয়া। মেয়েটার চরিত্রকে যাচ্ছেতাই হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সে যার তার সাথে ডেট করে, টাকা খায়, প্রেম করে বাজারে ঘুরে বেড়ায় বুকে ওড়না রাখে না ( ওড়না অনেকেই রাখেনা। এটা যে খারাপ এটা নাটকেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ) প্রেমের প্রতি ডেডিকেটেড না আরো অনেক খারাপ অবস্থা। সেখানে আরো এক মেয়ে অন্তরা। তাকে দেখা যায়, রিক্সায় হুড তুলে ঘনিষ্ট হবার বাহানায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নোয়াখালী থেকে এসে ছেলে বাগিয়ে শপিং করে যাচ্ছে। আরেকজন ভ্যাপ টানছে রুম ডেটিং করতে এসেছে। এক বুড়া আন্টি সে ও মারজুক রাসেলের সাথে ফোনে ট্যাংকি মারছে। সুইমিংপুলে নামছে, আরেক মেয়ে ছাদে নাচে তাকে হ্যাফ প্যান্ট গিফট্ করা হচ্ছে, সে ও নিচ্ছে !
আমার কথা হচ্ছে, মেয়েদেরকে সামাজিক ভাবে এইরকম হেয় করার মানে কি ! আমাদের দেশের মেয়েরা কি এখন এমন ? তাদের মধ্যে থেকে কি মোরালস বা মডেস্টি খুঁজে পাওয়া যায় না যে সব মেয়েকেই কাহিনীর বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এমনিতেই এভাবে ইথিকলেস ক্যারেক্টারলেস হিসেবে তুলে ধরতে হবে ? নাকি এটাকে সে খুব নরমাল হিসেবে চিলিং ফ্যাক্ট বানাতে চাচ্ছে ? কি মেসেজ দিতে চায় সে ?
এবারে আসি আরেক নাটক প্রসঙ্গে। সেটা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছে। রুনা খান তার স্বামীর সাথে যেসব গালাগালি করে সেগুলো নিয়েতো কথা বলাই দুষ্কর ! নাটকটিতে দেখানো হয় দুটো বাচ্চা তাদের বাবার মদ খেয়ে হাসপাতালে যায়। মদের টেস্ট কি আইসক্রিমের মতো ? বাচ্চাতো একটু খেয়েই বমি করে দেয়ার কথা। আর মুখে নেওয়ার কথা না। এই রকম যায় জান যায় জান টাইপ অসুস্থ্য হবে কি করে দুটো বাচ্চা ? বিষয়টি একদম হাস্যকর ! একজন উকিল সে মাইর খায়, রেইপড হয়। তাও এমন স্বামীর কাছে যে নাকি বিড়ি পর্যন্ত বউয়ের টাকায় খায়, বউয়ের বাড়িতে থাকে ! একটা মেয়েকে উকিল বানিয়েও ছোট করলো ! এই সমাজে কি এখন এরকম হয় ? এইরকম সেল্ফ ডিপেনডেন্ট উচ্চবিত্ত মহিলা কি এখন আছে ? যার জামাই ফতুর কিন্তু তাকে মারে, গালি দেয় রেইপ করে ? একটা নামকরা উকিল যে, সে নাকি এই ধরনের জামাই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে থাকবে ! আচ্ছা মানলাম। সে থাকছে। বাকী মেয়েদের কি অবস্থা দেখা যাক। সেই অত্যাচারিত উকিলের ফকির স্বামী জানিনা কার টাকা খরচ করে অফিসের মেয়েদের নিয়ে বাগান বাড়ি বা রিসোর্ট এ যায়। মেয়েটা বলে , মাকে কিছু টাকা দিলে মা বাজার করতো আর সে রিসোর্ট এ যেতো ! আমার কথা হচ্ছে এই পরিচালক কি অসুস্থ্য ? নাকি পারিবারিক শিক্ষার অভাব ওর ? নিজের ফ্যামিলিতে কেবলমাত্র এই ধরনের মেয়েই কি সে দেখে এসেছে ? তা না হলে তার নাটকে মেয়ে চরিত্র বলতেই এইসব নোংরা মেয়ে কেনো ? তার চিন্তায় কি ভালো মেয়ে নেই, স্ক্রীপ্ট সাজানোর মতো ?
এরপর, ভার্সিটির বন্ধু বান্ধবী। গাড়িতে উঠে একজন আরেকজনের প্রেমিককে চুমু খাচ্ছে। আরেকজন এসে আবার বলছে আমার বয়ফ্রেন্ডকে চুমা দেস ! আবার আরেকজন গাড়ি থামিয়ে জড়িয়ে ধরা দুইজনের ভিডিও করছে। খুন হচ্ছে। একটা মেয়ে নায়িকা হিসেবে দরিদ্র ঘরের ভালো ছিলো তাকেও এই কাজল আরেফিন অমি ভালো থাকতে দেয়নি। ওড়না খুলিয়ে ( এখানেও ওড়না ছাড়া চলা যে খারাপ এটা নাটকেই নির্দেশিত হয়েছে) স্মার্ট বানাতে গিয়ে প্রেম প্রেম ওম মাখিয়ে খুনী বানিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝিনা, মেয়েরা সস্তা। এই দেশের মেয়ে মানেই রাস্তার মেয়ে, সেক্স স্যমপল, এটাই কেনো তাকে বারবার প্রুফ করতে চাইতে হবে ? তার সমস্যা টা আসলে কোথায় ?
এবারে আসি ফিমেল ৪ নাটক প্রসঙ্গে। এই ঈদে সম্ভবত চার নম্বর পর্ব প্রচার হয়েছে। কোক এর এড করা নিয়ে নানান জটিলতা ছিলো। ব্যান হবার কথা ছিলো। আমার তো মনে হয় কোক টোক বাদ । রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ভাব মর্যাদা ক্ষুন্ন করবার জন্যে এই নাটক এবং এই কাজল আরেফিন অমিকে এমনিতেই ব্যান বা বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা উচিত।
ফিমেল নাটকে ইস্যু হিসেবে যে ফিমেলকে দেখানো হয় আর সে যে দুটো ড্রেস পরে রাস্তায় বেরহয় সেটা এই সমাজের মেয়ে হিসেবে একটা নাটকে তুলে ধরতে চাওয়াটা রীতিমত ন্যাক্কারজনক। আমাদের মা বোনদেরকে এভাবে ছোট হতে দেখতে আমার সত্যিই লজ্জা হয়েছে।
এক মোটকা তিনটা বিয়ে করেছে। তারমানে এখানে বোঝানো হয়েছে যে মেয়েরা সস্তা। এবং সহজলভ্য। টাকার কাছে বিক্রি হওয়া পণ্য। ঘটক যেসব মেয়ে আনছে আরেকজনের জন্য সেসব মেয়েরাও একজন দুই বাচ্চার মা, আরেকজন রাত কানা। রাত কানা রোগ কি এখন আছে ? আর দুই বাচ্চার মা হিসেবে একজন পাত্রীকে হেয়প্রতিপন্ন করা আসলেই কি অনুচিত হয়নি ?
এই নাটকে দেখানো হয়েছে সুইমিংপুলে ছেলে মেয়ে চুমু খাচ্ছে। এটা দেখে একজন বলছে, আমরা কি টাকা খরচ করছি না ? উত্তরে আরেকজন বলছে, তাতে কি আমরা তো বুড়া !
তারমানে, সুইমিং পুলের মেয়েরা টাকায় আনীত। প্রেম ভালোবাসা শ্রদ্ধা এই পরিচালকের কাছে কোন অবজেক্ট নয়। সাব্জেক্ট থাকবেতো দূরের কথা !
আর ইরেশ যাকেরতো জীবনের সব চাইতে বাজে চরিত্র করেছে এই নাটকে। বগলে মেয়ে নিয়ে চলে , মেয়ে নিয়ে ঘুমায়, মেয়ে নিয়ে মদ খায়, নাচে। রিভলভার নিয়ে ওলিগলি বেড়ায়। বাইকে শো ডাউন দেয় আরেক দল ! এসব দিয়ে কি আইনকে তুচ্ছ করা বোঝায় না? আমাদের দেশকি এতোই জঘন্য ? এতোই নোংরা আমাদের ছেলে মেয়েদের পরিবার ? কালচার ? আবার পথশিশু নিয়ে কিশোর গ্যাং বানানো হয়েছে। এরাও মারামারি করে !
এই কাজল আরেফিনের নাটক মানেই গালির বাইবেল ! সমাজে এইসব নাটক চলতে থাকলে গালিগালাজ, আর এইসব চুতিয়াবাজিকেই মানুষ আমাদের সমাজের স্বাভাবিক দিন যাপন রীতি হিসেবে শিক্ষা নেবে। কিংবা এই জীবন সবাই ভোগ করতে চাইবে।
এটাতো হতে দেয়া যায়না। একটা অসুস্থ্য মস্তিষ্কের লোক নাটকের পরিচালক হয় কিভাবে। কিভাবে সে আমাদের দেশের মেয়েদেরকে নোংরা আর অশ্লীল ভাবে উপস্থাপন করতে সাহস পায় ! আমাদের মা বোনেরা কি ওজনহীন ? বাজারি পণ্য ? সে কি বারবার তার নাটকের মাধ্যমে এটাই বোঝাতে চায় ?
এই পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করা জরুরী। কিন্তু কি বলবো এখনতো সময় গাঞ্জুট্টিদের! আমাদের কথায় কান দেবে, এমন মানুষ কই।
লেখক: কবি, ঔপন্যাসিক ও অভিনেত্রী