■ নাগরিক নিউজ ডেস্ক ■
২০০৩ সালের ১৯শে মার্চ তৎকালীন খালেদা জিয়া মিয়ানমার সফর করেন। ইরাক যুদ্ধের ডামাডোলে তখন এই সফর তেমন গুরুত্ব পায়নি। তবে বাংলাদেশের জন্য এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের এই গোপন প্রতিবেদনে। বলা হচ্ছে, ভারত ও তার সহযোগীদের চক্রে আটকে পড়া থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে খালেদা জিয়ার সরকার পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়।
গোপন প্রতিবেদনটির অনুবাদ:
১. (গোপন) সারসংক্ষেপ: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তিনদিনের বার্মা সফরে বাণিজ্য, পরিবহন সংযোগ ও শরণার্থীদের বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা হয়নি, তবে বাংলাদেশের ডিফেন্স অ্যাটাশে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ তার সীমান্ত এলাকায় সাফাই অভিযান অব্যাহত রেখেছে। শেষ সারসংক্ষেপ।
২. (গোপন) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সফর খুবই সফল হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের ডিফেন্স অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার সলিম আখতার। এই সফর ছিল বার্মার রাষ্ট্রপতি থান শ্বের ডিসেম্বর ২০০২ সালে বাংলাদেশের সফরের প্রতিদান হিসেবে এবং বার্মা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন আগ্রহকে তুলে ধরার প্রয়াস। ২০ মার্চ বেগম জিয়া থান শ্বের সঙ্গে প্রায় ৯০ মিনিট বৈঠক করেন এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মত হন, যার মধ্যে রয়েছে:
ঢাকা-রেঙ্গুন সড়ক সংযোগ: ব্রিগেডিয়ার সলিমের মতে, এটি নাফ নদীর উপরের দিকে একটি ছোট সেতু ও বার্মার রাখাইন রাজ্যে একটি সংক্ষিপ্ত সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরই সেতু ও সড়ক নির্মাণ শুরু হবে।
উপকূলীয় শিপিং: ২০ মার্চ স্বাক্ষরিত এক সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও রেঙ্গুনের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হবে। এতদিন এই দুই দেশের কার্গো সিঙ্গাপুর হয়ে যেত।
বাণিজ্য: দ্বিতীয় একটি সমঝোতা স্মারক যৌথ বাণিজ্য কমিশন ও দ্বিপাক্ষিক ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট গঠন করেছে, যা বাণিজ্যকে সহজ করবে।
শরণার্থী: মূলত উভয় দেশ রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী ইস্যুকে আর না টানার বিষয়ে একমত হয়। বার্মা তাদের প্রকৃত নাগরিক প্রমাণিত শরণার্থীদের ফেরত নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়; বাংলাদেশ কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি দেয়নি, তবে যারা ফিরতে পারবে না বা চায় না, তাদের গ্রহণ করতে মৌখিক সম্মতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ নিয়ে বার্মার ব্যবসায়ী মহলে আশাবাদ
৩. (গোপন) মিয়ানমার চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (UMCCI) সদস্যদের মতে, খালেদা জিয়ার সফরের সঙ্গে থাকা বাণিজ্য মেলা দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত করতে পারে। বর্তমানে বার্মার রপ্তানি পণ্যের বড় অংশই চোরাইপথে আসে (মূলত চাল) অথবা চীনা পণ্য ট্রান্সশিপমেন্ট হয়। ব্যবসায়ীরা মনে করেন বৈধ বাণিজ্য কিছুটা বৃদ্ধি পাবে (যেমন বার্মা থেকে কৃষিপণ্য ও কাঠের বদলে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ ও সিমেন্ট)।
ভুয়া গুজব
৪. (গোপন) সলিম জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশে থাকা ইউএস কোম্পানিগুলো (মূলত ইউনোকাল) বার্মার রাখাইন উপকূলের একটি সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশ ও সেখান থেকে ভারতে গ্যাস পাইপলাইন নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু বার্মা বা বাংলাদেশ কোনো সরকারিভাবে এটি সমর্থন করেনি। একইভাবে বার্মার কৃষিজমি বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের কাছে ইজারা দেয়ার খবরগুলোও ছিল শুধুই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আলোচনা; আনুষ্ঠানিক আলোচনায় এটি আসেনি।
সন্ত্রাসবাদ
৫. (গোপন) সলিম আরও জানিয়েছেন, সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়নি। তবে বার্মা বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের কথা জানত। সলিম বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জুন ২০০২, ডিসেম্বর ২০০২ ও ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে অভিযান চালায়। লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (RSO) অস্ত্রপাচার, যা থাইল্যান্ড থেকে অস্ত্র এনে বাংলাদেশে অপরাধী চক্রের কাছে দিত। সলিম জানান, RSO-র ১৫০ থেকে ২০০ জন সদস্য আছে এবং তারা মূলত উপদ্রব, বড় কোনো হুমকি নয়। তবুও বাংলাদেশ সরকার এটিকে দমন করতে বদ্ধপরিকর এবং জুন ২০০৩-এর মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে চায়।
কৌশল
৬. (গোপন) সলিম বলেন, বার্মার সঙ্গে নতুন এই উন্মুক্ত সম্পর্ক বাংলাদেশের নিজস্ব “লুক ইস্টওয়ার্ড” নীতির অংশ। ৯০-এর দশকের শুরুতে ভারত যেভাবে চীন ও তার মিত্রদের ঘেরাওয়ের আশঙ্কা থেকে বার্মার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করেছিল, বাংলাদেশও একইভাবে ভারত ও তার মিত্রদের ঘেরাওয়ের আশঙ্কায় এই পদক্ষেপ নিয়েছে। সলিম বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সম্ভাবনাও এই আগ্রহের পেছনে কাজ করছে। এতদিন বাংলাদেশ ভারত, চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে গুরুত্ব দেয়নি। এই সফর এবং ডিসেম্বর ২০০২-এ বেগম জিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ঠাকসিনের সফর ছিল একটি বিস্তৃত ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক নীতির অংশ।
মন্তব্য
৭. (গোপন) বাংলাদেশ হলো সর্বশেষ দেশ যারা বার্মার গুরুত্ব বুঝেছে। চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশও মনে করছে বার্মার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন থেকে অনেক কিছু পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে, বার্মার শাসক এসপিডিসি পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও প্রতিবেশী দেশ ও আসিয়ান অংশীদারদের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে সফল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফর ও থান শ্বের ভিয়েতনাম সফরের ধারাবাহিকতায় এই কূটনৈতিক উদ্যোগ এখন সেই দেশগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করছে যাদের সঙ্গে বার্মার ঐতিহাসিকভাবে তেমন সম্পর্ক ছিল না। শেষ মন্তব্য।
সূত্র: ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট কেবল, ২৮শে মার্চ, ২০০৩