■ মুজতবা খন্দকার ■
খালেদা জিয়া মিথ্যা মামলা আর প্রহসনের বিচারে যে দিন জেলে গেলেন তার একদিন আগে নেতাকর্মীদের বলে গিয়েছিলেন তার জন্য কোনো আন্দোলন যেন না করা হয়। বিএনপির নেতাকর্মীরা সে আহবান উপেক্ষা করেনি। তাঁরা খালেদা জিয়ার জেলদন্ডের প্রতিবাদে একদিনও কোনো হরতাল করেনি।
অথচ বিএনপির নেতাকর্মী কেন গোটা দেশের মানুষ জানত হাসিনা প্রতিহিংসাবশত খালেদা জিয়াকে জেলে দিয়েছে। কারন, যে মামলায় খালেদা জিয়ার জেলদন্ড হয়েছে ঐ মামলার আদৌ কোনো সারবত্তা নাই। সুতরাং দলের নেত্রীর জন্য আন্দোলনের কর্মসূচী দিলে সেটা ন্যায্যতা পেতো সবার কাছে। কিন্তু নেত্রীর নির্দেশ মেনে শুধুমাত্র খালেদা জিয়ার জন্য কোনো কর্মসূচী বিএনপি দেয়নি। কিন্তু রহস্যটা অন্য জায়গায়। প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন খালেদা জিয়া সেদিন তার জন্য আন্দোলন করতে বারন করেছিলেন। জানিনা, বিএনপির কোনো নেতা পাঁচ আগষ্ট হাসিনা ভারতের পালিয়ে যাবার পর তার মুক্তির পরে এটা জানার চেষ্টা করেছিলেন কি না?
তবে, আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। হাসিনা খালেদা জিয়াকে দন্ড দেবার আগে জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিতর্কিত এবং ক্রুটিপূর্ন রায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়। সেই সময়ে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতের বিরুদ্ধে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন খালেদা জিয়া। জামায়াত নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দন্ড পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার দন্ড সবই ছিলো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর নীলনকশার অংশ। প্রথমে জামায়াতকে এই বিচারের নামে ছত্রভঙ্গ এবং নেতৃত্বশূন্য করেছে হাসিনা। আর খালেদা জিয়াকে জেলদন্ড দিয়ে বিএনপিকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করতে চেয়েছিলো সে। দ্বিধাবিভক্ত করতে চেয়েছিলো নেতাদের।
খালেদা জিয়া হচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের প্রতীক। আর শেখ হাসিনা এমন একজন যিনি কি না দেশের সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছেন। পার্থক্যটা মোটা দাগের। কিন্তু এদেশের হিন্দুস্থানীয় বুদ্ধিজীবী দুই নেতার মধ্যে ফারাক খোঁজেন না। এরা ধূর্ত,অসৎ। এদের আমি করুনা করি।
‘র’ এর নীলনকশা খালেদা জিয়া জানতেন, তিনি এও জানতেন, বিএনপি ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর জোটসঙ্গীদের নিয়ে এত বড় আন্দোলন করলো। দেশকে অচল করে দিলো, কিন্ত হাসিনার সরকারী মেশিনারিজের সাথে কেন পেরে উঠলো না বিএনপি। কারন খালেদা জিয়া বুঝে গিয়েছিলেন, বিএনপির এই লড়াইটা শুধু শাসকের বিরুদ্ধে কেবল ছিলোনা। এটা ছিলো ভারতের ‘র’-এর বিরুদ্ধেও। কারন হাসিনাকে ঘিরে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তারের যে ছক ‘র’ কষেছিলো সেটা পূরন করতে হলে জাতীয়তাবাদী শক্তি বিএনপিকেও দুর্বল করতে হবে।
আর তার জন্য খালেদা জিয়াকে নিষ্ক্রিয় করাটা জরুরী এবং অবশ্যম্ভাবি ছিলো। আর তাই ‘র’ এর সমর্থনে হাসিনা খালেদা জিয়াকে জেলদন্ড দেয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপুল জনপ্রিয় নেতা খালেদা জিয়া। হাসিনা সেটা নিজেও জানতেন, তাই প্রথমে দ্বিধান্বিত থাকলেও ‘র’- এর আশ্বাসে সেটা সফলভাবে করতে পারে। আর এই বিষয়টা খালেদা জিয়া বুঝেছিলেন বলে তার জেলদন্ডের প্রতিবাদে কোনো আন্দোলন করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আন্দোলনে নামলে বিএনপিকে বহুধা বিভক্ত করা সহজ হবে। দলের সবাই তো তুলসি পাতা নয়। হাসিনা বিএনপির অনেক নেতাকে আবার সেসময় টার্গেটও করেছিল।
ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমেদের সাথে আমার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো। প্রায় তিনি আমার টকশোতে আসতেন। এমন একটি টকশোর পর আমি তাকে বললাম, গুঞ্জন শুনছি আপনি.. আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এই বয়সে আমার দল চেঞ্জ! ছাত্রদল তো আমাকে আস্ত রাখবেনা। আর কদিনই বা বাঁচবো। দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীও তো ছিলাম…..।
‘র’ এর নীলনকশা খালেদা জিয়া জানতেন, তিনি এও জানতেন, বিএনপি ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর জোটসঙ্গীদের নিয়ে এত বড় আন্দোলন করলো। দেশকে অচল করে দিলো, কিন্ত হাসিনার সরকারী মেশিনারিজের সাথে কেন পেরে উঠলো না বিএনপি। কারন খালেদা জিয়া বুঝে গিয়েছিলেন, বিএনপির এই লড়াইটা শুধু শাসকের বিরুদ্ধে কেবল ছিলোনা। এটা ছিলো ভারতের ‘র’-এর বিরুদ্ধেও। কারন হাসিনাকে ঘিরে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তারের যে ছক ‘র’ কষেছিলো সেটা পূরন করতে হলে জাতীয়তাবাদী শক্তি বিএনপিকেও দুর্বল করতে হবে।
মওদুদ আহমদের কাছ থেকে এরকম অনেক বিএনপি নেতার নাম তখন শুনেছিলাম। কিন্ত খালেদা জিয়ার প্রজ্ঞা আর প্রত্যুত্বপন্ন নেতৃত্ব সেদিন দলকে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। তিনি এই আশঙ্কায় কথা দলের সিনিয়র নেতাদেরও জানিয়েছিলেন বলে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আমাকে সেদিন বলেছিলেন।
বিএনপি আন্দোলন করতে পারেনি; খালেদা জিয়াকে জেল থেকে মুক্ত করতে পারেনা। যে দল সেই দল এখন বড় বড় কথা বলে এমন খোট্টা বিএনপির নেতৃত্বকে প্রায়শ এখন শুনতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যারা এটা বলে এদের বেশীরভাগই হাসিনার সময়ে মুক ও বধির ছিলো। আর ছাত্রদের মধ্যে যারা বলে তাদের অনেকেই ছিলেন ছাত্রলীগের জয়বাংলার পদতলে।
কখনো কখনো যুদ্ধের চেয়ে, যুদ্ধ না করে নিজের শিবির অক্ষত রাখাটাও অনেক বড় রণকৌশল।
ডক্টর ইউনূসের সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ দিচ্ছেনা বলে বিএনপি নেতাদের মনে ক্ষোভ আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কারন ঘর পোড়া গরুরতে সিঁধুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এক-এগারোর জরুরী সরকারের ট্রমা বিএনপির চেয়ে কেউ বেশী বহন করছেনা। সেই সময়ে বিএনপিকে নিয়ে যে নোংরামিটা হয়েছিলো সেটা বেগম জিয়া ও তার পরিবারের চেয়ে খুব বেশী কেউ ভোগ করেনি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন সেটা ইউনূসকে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। তাঁর আন্তর্জাতিক ইমেজ সস্পর্কে খালেদা জিয়া যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।
বুঝতে হবে তারেক রহমান বিএনপির মত সবচেয়ে বিপুল জনপ্রিয় দল এখন পরিচালনা করছেন। আর খালেদা জিয়া এখন কার্যত রাজনীতি থেকে দূরে। তিনি আছেন অনেকটা অবজারভার, অনেকটা দেশের ন্যায়দন্ডের প্রতীক হিসেবে। দেশের গার্ডিয়ান কিম্বা ভ্যানগার্ড হিসেবে। তার প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম তুলনাহীন। সুতরাং তিনি ডক্টর ইউনূস সরকাররের বিরুদ্ধে কঠোর না হতে বিএনপিকে যে পরামর্শ দিয়েছেন,সেটা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই বর্হিপ্রকাশ।
আমি কেন খালেদা জিয়াকে পছন্দ করি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকালীন সময়ে আমি তাকে বেছে নিয়েছিলাম কারন তাঁর মধ্যে জিয়ার দেশপ্রেম, পরিমিতিবোধ স্বল্পভাষী এবং কাউকে এতটুকু সমালোচনা না করে দেশের জন্য কাজ করার একাগ্রতা দেখেছিলাম।
আজ জীবন সায়াহ্নে আরো একবার তাঁকে দেশপ্রেমিকের ভূমিকায় দেখলাম, স্যালুট ম্যাডাম আপনাকে।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য কি জানেন, বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার মতন একজন নেতা এসেছিলেন। আরো দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তিনি হাসিনার সমসাময়িক সময়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন। আর সে কারনে, আমাদের গল্পকথকেরা সব সময় খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার সাথে তূলনা করতে পছন্দ করেন। যেটা খালেদা জিয়ার প্রতি সম্পূর্ণ অবিচার।
খালেদা জিয়া হচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের প্রতীক। আর শেখ হাসিনা এমন একজন যিনি কি না দেশের সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়েছেন। পার্থক্যটা মোটা দাগের। কিন্তু এদেশের হিন্দুস্থানীয় বুদ্ধিজীবী দুই নেতার মধ্যে ফারাক খোঁজেন না। এরা ধূর্ত,অসৎ। এদের আমি করুনা করি।
লেখক: যুগ্ম প্রধান বার্তা সস্পাদক, এনটিভি
mujtobantv@gmail.com