■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আগামী তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর জানাজার জন্য আগামীকাল বুধবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার দুপুরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমি তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক এবং আগামীকাল তাঁর নামাজে জানাজার দিনে একদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন ‘আজ আমাদের পুরো জাতি গভীর শোক ও বেদনায় নিস্তব্ধ। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির শীর্ষ নেত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে তাঁরা গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত। তাঁর মৃত্যুতে জাতি এক মহান অভিভাবককে হারিয়েছে। এই গভীর শোকের মুহূর্তে তিনি খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্য, রাজনৈতিক সহকর্মী এবং অগণিত কর্মী-সমর্থকের প্রতি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে আন্তরিক সমবেদনা জানান। তিনি বলেন ‘মহান আল্লাহর কাছে আমার প্রার্থনা—তিনি যেন আমাদের সবাইকে এই গভীর শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দান করেন।’
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক পরম মহিমান্বিত ব্যক্তিত্ব। গণতন্ত্র, বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর অসামান্য ভূমিকা ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন নেতৃত্ব বারবার জাতিকে গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে এবং মুক্তির প্রেরণা জুগিয়েছে। দেশ ও জাতির প্রতি তাঁর সমুজ্জ্বল অবদান জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা, গণমুখী নেতৃত্ব এবং প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখতে তাঁর অবিচল ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এমন একজন মহান, দূরদর্শী ও নিখাদ দেশপ্রেমিক নেত্রীর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন ‘এই শোকাবহ মুহূর্তে আপনাদের প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান—আসুন আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে মহান আল্লাহর দরবারে বেগম খালেদা জিয়ার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। একই সঙ্গে জাতির এই কঠিন সময়ে আমরা যেন ঐক্যবদ্ধ থাকি। শোকের এই সময়ে কেউ যেন অস্থিতিশীলতা বা নাশকতার অপচেষ্টা চালাতে না পারে, সে বিষয়ে আমি সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এই সময়ে আমাদের সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি।’
খালেদা জিয়ার নামাজে জানাজাসহ সব ধরনের শোক পালনে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন ‘আমি জানি, আপনারা সবাই এই সময়ে অনেক আবেগাপ্লুত। আমি আশা করছি, শোকের এই সময়ে আপনারা ধৈর্যের পরিচয় দেবেন এবং তাঁর জানাজাসহ সব আনুষ্ঠানিকতা পালনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা করবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে ধৈর্য, শক্তি ও ঐক্যবদ্ধ থাকার ক্ষমতা দিন।’
উল্লেখ্য, বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু সংবাদটি নিশ্চিত করেন তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।
এ সময় হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ছেলের বউ ডা. জোবায়দা রহমান, নাতনি জাইমা রহমান, ছোট ছেলের বউ শার্মিলী রহমান সিঁথি, ছোট ভাই শামীম ইসকান্দার, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, বড় বোন সেলিনা ইসলামসহ সকল আত্মীয় স্বজন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের সকল চিকিৎসকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সোমবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. জিয়াউল হক জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। তিনি অনেকটা লাইফ সাপোর্টে আছেন।’ রাতে অবস্থার অবনতি হলে তাঁর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং পরিবারের সদস্যারা হাসপাতালে যান। রাত ২টার পর এজেডএম জাহিদ হোসেন হাসপাতালের সামনে এসে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া ‘অত্যন্ত সঙ্কটময়’ সময় অতিক্রম করছেন। উনার পরিবারের পক্ষ থেকে উনার সুস্থতার জন্য মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে দেশবাসীকে দোয়া করার আহ্বান জানাচ্ছি। এর কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিএনপি চেয়ারপারসনকে মৃত ঘোষণা করেন।
খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। গত ২৩ নভেম্বর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার চিকিৎসা তদারকি করেন। এই মাসের শুরুতে চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় পরবর্তীতে তা সম্ভব হয়নি।
