বিধ্বস্ত এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের উৎপাদন বন্ধ করেছিল চীন

■ নাগরিক প্রতিবেদক ■

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে অন্তত ২২ জন নিহত ও ১৭১ জন আহত হয়েছেন। এই দুর্ঘটনার পর চীনের তৈরি তুলনামূলক কিছুটা সাশ্রয়ী এফ-৭ বিজিআই (F-7 BGI) যুদ্ধবিমান নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

যুদ্ধবিমান ও বিমানের যন্ত্রাংশের নকশা প্রণয়ন এবং উৎপাদানকারী চীনা কোম্পানি চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের (সিএসি) তৈরি এফ-৭ বিজিআই মূলত বহুমুখী অভিযান ও উন্নত প্রশিক্ষণে সক্ষম একটি হালকা যুদ্ধবিমান। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী বিশেষভাবে এই বিমান তৈরি করে চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন।

বিধ্বস্ত হওয়া এফ-৭ যুদ্ধবিমানটি চেংদুর এফ-৭ সিরিজের ফাইটার বিমানের আধুনিক সংস্করণ। সোভিয়েত আমলের মিগ-২১ এর মডেলের আদলে এই বিমানটি তৈরি করে চীন। বৈশ্বিক মানদণ্ডে পুরোনো এবং সেকেলে এফ-৭ বিমান তুলনামূলক কিছুটা সাশ্রয়ী।

পাইলটদের প্রশিক্ষণে ও যুদ্ধকালীন সীমিত ভূমিকা রাখতে পারে এই বিমান। ২০১৩ সালে চীন ১৬টি এফ-৭ বিমান বাংলাদেশে রপ্তানি করে। সেটিই ছিল এই বিমানের শেষ চালান। এরপর থেকে চীন এফ-৭ বিমানের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

চীনের চেংডু এয়ারক্রাফট করপোরেশন (সিএসি)। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য চীনে এটি জে-৭ নামে পরিচিত। তবে রপ্তানির সময় এর নামকরণ হয় এফ-৭।

১৯৬০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির বহরে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় উড়তে সক্ষম ও দ্রুতগামী জেট ছিল জে-৭। আধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট এয়ারফোর্স টেকনোলজি ডটকম এর তথ্য অনুযায়ী, জে-৭ এর নকশার অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়কালে তৈরি যুদ্ধবিমান এমআইজে-২১ থেকে।

এভিয়েশনভিত্তিক ওয়েবসাইট এয়ারোস্পেস গ্লোবাল নিউজের তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানির সময় চীনা কোম্পানিটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান আমদানিকারকের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করে। সে সময় এর নামের সঙ্গে কিছু সংকেত ব্যবহার করা হয়। যেমন, বাংলাদেশ যদি এই সিরিজের যুদ্ধবিমান আমদানি করে তাহলে এফ-৭ এর পর ইংরেজি অক্ষর ‘বি’ যুক্ত হবে। আর গ্লাস ককপিটের নকশার ক্ষেত্রে ‘জি’ এবং উন্নত সংস্করণ বোঝাতে ইমপ্রুভড এর ‘আই’ যুক্ত হবে। এ সংস্করণের যুদ্ধবিমানে থাকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল গ্লাস ককপিট, উন্নত রাডার ব্যবস্থা ও অ্যাভিওনিক্স (ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা) প্রযুক্তি।

এয়ারোস্পেস গ্লোবাল নিউজ (এজিএন) বলছে, এই ধরনের জেট সারা বিশ্বেই আকাশ প্রতিরক্ষা, বহুমুখী অভিযান ও পাইলদের প্রশিক্ষণের জন্যও ব্যবহার হয়। তবে নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের চেয়ে এর দুর্ঘটনার হার বেশি। এর কারণ, পুরোনো নকশার এয়ারফ্রেম, সীমিত নিরাপত্তা, আধুনিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব।

২০০৮ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়িপাড়া গ্রামে পাইলটসহ বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এতে নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তখন সম্ভাব্য কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়। 

২০১৫ সালের জুনে এফ-৭ এমবি ৪১৬ মডেলের একটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়। নিখোঁজ হন পাইলট তাহমিদ রুম্মান। এটি বিমান বাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছিল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কয়েক মিনিট পর যুদ্ধবিমানটি পতেঙ্গা সৈকতের প্রায় ৬ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরে বিধ্বস্ত হয়।

২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণের সময় টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ বিজি। এতে নিহত হন পাইলট আরিফ আহমেদ। এয়ারক্রাফটটি ঢাকা থেকে উড্ডয়নের ২৫ মিনিটি পর মধুপুরের রসুলপুর এলাকায় বিধ্বস্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।

পাকিস্তানে ২০১৫ সালের নভেম্বরে ও ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এই সংস্করণের জেট বিধ্বস্ত হয়ে তিন পাইলট নিহত হন। ২০২২ সালের ২৪ মে এফ-৭ বিধ্বস্তে ইরানের ইসফাহানে দুই পাইলট নিহতের খবর দেয় ডেইলি সাবাহ।

এভিয়েশনভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এফ-৭ কম স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধবিমান। তাই দ্রুত গতিতে এবং কম উচ্চতায় প্রশিক্ষণের সময় পাইলটদের বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী সাশ্রয়ী ও বহুমুখী অভিযানে পারদর্শী যুদ্ধবিমান হিসেবে এফ-৭ বিজিআই তৈরি করেছে (সিএসি)। জে-৭জির উন্নত সংস্করণ হিসেবে তৈরি করা এফ-৭ বিজিআইতে বিমান পরিচালনা এবং যুদ্ধ-দক্ষতার দিক থেকে নাটকীয় উন্নতি আনা হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী  যুদ্ধবিমানের বহর আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে এই মডেলের ১৬টি বিমান আমদানি করে।

চীনে চেংদু জে-৭ নামে পরিচিত এফ-৭ যুদ্ধবিমান মূলত এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিসরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমানবাহিনীর বহরে এই যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হচ্ছে।

• এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানের বৈশিষ্ট্য

• গতি ও শক্তি : এফ-৭ বিজিআইয়ের সর্বোচ্চ গতি মাক-২.২। এক আফটারবার্নিং ইঞ্জিন দ্বারা পরিচালিত এই বিমান ৮২ কিলোনিউটন শক্তি উৎপন্ন করে।

• উন্নত ককপিট : বিমানের ককপিটে তিনটি মাল্টি-ফাংশনাল এইচইউডি ডিসপ্লে ও এইচওটিএএস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যবহৃত হয়েছে। এর ফলে পাইলটকে প্রতি মুহূর্তে উচ্চ সতর্কাবস্থায় থেকে বিমানটি পরিচালনা করতে হয়।

• নতুন রাডার : এফ-৭ বিজিআই বিমানে কেএলজে-৬এফ ফায়ার কন্ট্রোল রাডার রয়েছে। যা ৮৬ কিলোমিটারেরও বেশি দূরের লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে পারে। এছাড়া একই সময়ে একসঙ্গে ছয়টি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও একযোগে দুটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে বিমানটি।

• চালনার ক্ষমতা : এফ-৭ বিজিআই বিমানে জে-৭জি২ এয়ারফ্রেম এবং ডাবল-ডেল্টা উইং ডিজাইন ব্যবহৃত হওয়ায় এটি অনেক উঁচুতে উঠে আক্রমণ চালাতে পারে। এর ফলে এই বিমানের স্থবির হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। সমসাময়িক অনেক যুদ্ধবিমানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে এফ-৭ বিজিআইয়ের।

• অস্ত্র বহন ও হামলার সক্ষমতা : এফ-৭ বিজিআই বিমানে সাতটি হার্ড-পয়েন্ট রয়েছে। এর ফলে বিমানটি পিএল-৫, পিএল-৭, পিএল-৯ এমনকি পিএল-১২ এর মতো স্বল্প পাল্লার এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। পাশাপাশি বোমা, আনগাইডেড রকেট এবং সর্বোচ্চ ৩ হাজার পাউন্ড ওজনের চীনা লেজার গাইডেড বোমা নিক্ষেপেও সক্ষম এই বিমান।

• বিশেষ সক্ষমতা: চীনের তৈরি এই বিমান জাহাজ-বিধ্বংসী সি-৭০৪ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে এফ-৭ বিজিআই বিমান।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন এফ-৭ বিজিআইয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ও প্রযুক্তির বিশেষ ব্যবহার করলেও এটি মূলত স্বল্প-পাল্লার আকাশযুদ্ধ এবং প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত। আধুনিক বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী যুদ্ধবিমানের মতো এই বিমানের দৃষ্টিসীমার বাইরে (বিভিআর) ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার সক্ষমতা নেই।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *