বামপন্থী রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর মারা গেছেন

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

লেখক, গবেষক, রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রোববার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বদরুদ্দীন উমরের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।

সকালে তিনি বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে অসুস্থ অবস্থায় বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ১০টা ৫ মিনিটে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করা বদরুদ্দীন উমর পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।

বদরুদ্দীন উমর বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়িয়ে তিনি একজন লেখক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও নানা প্রয়োজনের সময় তিনি দক্ষতার সঙ্গে বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন।

বদরুদ্দীন উমরের বাবা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে বর্ধমান টাউন স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৫০ সালে বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি অর্জন করেন।

তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৬৮ সালে শিক্ষকতা ত্যাগ করে সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যোগ দেন। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় একশ এবং সেগুলো দুই বাংলাতেই সমাদৃত। সংবাদপত্রে দীর্ঘদিন নিয়মিত কলামও লিখেছেন তিনি।

বদরুদ্দীন উমরের গবেষণামূলক কাজের মধ্যে রয়েছে ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তিন খণ্ডে), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি’, ‘বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তর’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ’ এবং ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক’।

২০২৫ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন কিন্তু তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা পুরস্কার দিতে চেয়েছে। আমি কখনোই সেগুলো গ্রহণ করিনি। এবারও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে স্বাধীনতা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে, আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই, তবে এই পুরস্কার গ্রহণ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

পুরস্কার না নেওয়ার পেছনে তার সুস্পষ্ট যুক্তি ছিল। ‘প্রতিধ্বনি’ নামের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমি যে লেখালেখি করি, তা করি নিজের ভেতরের তাগিদ থেকে। এর জন্য পুরস্কার পাওয়ার কথা ভাবি না। লেখকের প্রকৃত পুরস্কার হচ্ছে— মানুষ তার লেখা পড়বে, চিন্তা করবে, উপকৃত হবে।

তিনি আরও বলেন, পুরস্কার অনেক সময় লেখকের স্বাধীন চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। রাষ্ট্র বা ধনিকশ্রেণি যখন পুরস্কার দেয়, তখন তার পেছনে থাকে লেখককে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা। একবার পুরস্কার নিলে পরবর্তীতে আরও পুরস্কারের প্রত্যাশা তৈরি হয়, যা লেখার স্বাধীনতা নষ্ট করে।

নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি উদাহরণ দেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর। বলেন, মহাশ্বেতা দেবী শুরুতে পুরস্কার গ্রহণ না করার নীতি গ্রহণ করলেও পরে নোবেল থেকে ম্যাগসেসে— সব ধরনের পুরস্কার নিয়েছেন। এতে তার লেখার মান কমেছে এবং রাজনৈতিক আপসহীনতাও ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

বদরুদ্দীন উমরের মতে, একজন লেখককে সত্যিকার অর্থে মুক্ত থাকতে হলে পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই রয়েছে তার সততা ও নৈতিক শক্তির প্রকাশ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *