চিরনিদ্রায় শায়িত মাগুরার নির্যাতিত শিশুটি

■ মাগুরা প্রতিনিধি ■

মাগুরায় ধর্ষণ ও নির্যাতনে মারা যাওয়া আট বছরের শিশুটির মরদেহ দাফন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) বাদ এশা শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম সোনাইকুন্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সোনাকুন্ডী সম্মিলিত ঈদগা ও গোরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। 

চোখের জলে শিশুটিকে চিরবিদায় জানায় এলাকাবাসী। জানাজায় অংশ নেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, মাগুরার জেলা প্রশাসক অহিদুল ইসলাম প্রমুখ। 

এর আগে দুপুরে শিশুটি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়। সন্ধ্যার আগে তার মরদেহ নিয়ে সিএমএইচ থেকে হেলিকপ্টারে মাগুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সেনাবাহিনী। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টাটি মাগুরা স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে মেয়েটির মরদেহ শহরের নোমানী ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। 

এর আগে সকালে একে একে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় মাগুরায় ধর্ষণের শিকার ৮ বছরের শিশুটির। দুপুরে তৃতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর আর হৃদস্পন্দন ফেরেনি অভিমানী হৃদয়ে। ঘৃণা, লজ্জা, অভিমানে জমে থাকা শ্বাস চিরমুক্তি নিয়ে অসীমে মিলিয়ে গেছে।

এর আগে, দুপুরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটি। তার মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

আইএসপিআর জানিয়েছে, অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানানো যাচ্ছে যে, মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটি আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) সর্বাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

শিশুটির মৃত্যুর খবরে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ছুটে যান জাতীয় নাগরিক পার্টির দুই মুখ্য সংগঠক, বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।

এদিকে শিশুটির মৃত্যুর খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কাঁদছেন শিশুটির স্বজন ও প্রতিবেশীরা। দুপুরে তার মৃত্যুর খবর তার বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের জারিয়া গ্রামে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন আতীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ এলাকাবাসী।

মাগুরার বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ ছুটে আসে তাদের বাড়িতে। পুরো এলাকায় চলছে শোকের মাতম। শিশু, কিশোর-কিশোর, নারী-পুরুষসহ নানা বয়সী মানুষের একটাই দাবি- ধর্ষকের ফাঁসি চাই, ফাঁসি। এ ঘটনার শাস্তি দাবি করেন তারা। 

শিশুটির খালা ধোলায় বেগম রোকেয়া আহাজারি করে বলেন, আমাদের মনি আর নেই। আমরা মনিরে আর জীবিত দেখতে পারব না। আমরা সঠিক বিচার চাই।

গত ৫ মার্চ বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি। পরে শিশুর মা বাদী হয়ে ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার ৪ আসামি আগে থেকেই পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। মামলার পর তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। মূল অভিযুক্ত ভুক্তভোগী শিশুর বোনের শ্বশুরকে ৭ দিন ও বাকি ৩ আসামি- বোনের স্বামী, শাশুড়ি ও ভাসুর প্রত্যেককে ৫ দিনের রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে মাগুরার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যান তার বোনের শাশুড়ি। পরে শিশুটির মা হাসপাতালে যান। সেদিন দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার রাতে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর গত শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় শিশুটিকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (পিআইসিইউ) থেকে সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। তাকে ঢাকার সিএমএইচের পিআইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।

শিশুটির চিকিৎসায় সিএমএইচের প্রধান সার্জনকে প্রধান করে আটজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল।

মাগুরার এ ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দা ও সমালোচনা চলছে। ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চলছে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। 

সেই ধর্ষকের বাড়িতে জনতার আগুন

সেই ধর্ষকের বাড়িতে জনতার আগুন

মাগুরায় সেই শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) রাত পৌনে ৮টার দিকে শহরের নিজনান্দয়ালী চরপাড়ায় ধর্ষক হিটু শেখের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় স্থানীয় জনতা।

শিশুর মৃত্যুর খবর শোনার পরপরই মাগুরায় শুরু হয় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ। ছাত্র-জনতা শহরে একাধিক বিক্ষোভ মিছিল শেষে শহরের ভায়না এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখে।

মৃত্যুর খবর শোনার পরপরই তার বাড়িতে ছুটে যান সর্বস্তরের জনগণ। ইফতারের পরপরই তার মরদেহ নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার জেলা স্টেডিয়ামে এসে পৌঁছায়।

সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে আসা হয় নোমানী ময়দানে। সেখানে সন্ধ্যা সাতটায় জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজায় স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ছাত্র-জনতা অংশ নেয়।

জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি জেলার শ্রীপুর উপজেলার সোনাইকুন্ডী গ্রামে। সেখানে আরেক দফা জানাজা শেষ দাফন সম্পন্ন করা হয়। এরপর জনতা অভিযুক্তদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। 

জবিতে সেই শিশুর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত

মাগুরায় বোনের বাড়িতে ধর্ষণ-নিপীড়নের শিকার শিশুটি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। তার মৃত্যুতে গায়েবানা জানাজা পড়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষার্থীরা। 

বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে এই গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

এ সময় জবি শাখা ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি আসাদুল ইসলাম বলেন, আমরা এই ধরনের ঘটনা আর দেখতে চাই না। এ ধরনের গায়েবানা জানাজা আর পড়তে চাই না। ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকার্য শেষ করতে হবে। এছাড়া ধর্ষক প্রমাণিত হলে একমাত্র এবং সর্বনিম্ন শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে।

শাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক মাসুদ রানা বলেন, শিশুটির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় সমাজের নৈতিকতার চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে। আর যাতে এরকম ঘটনা না ঘটে সেজন্য সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ধর্ষণের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

ইসলামি ছাত্রশিবির জবি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আলিম আরিফ বলেন, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করি, ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়ি। আফিয়ার এই মৃত্যু  আমাদের জন্য শিক্ষা। আমরা ধর্ষকের সর্বোচ্চ সাজা চাচ্ছি। বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা কম চাচ্ছি। আমরা ধর্ষক মুক্ত, ন্যায়, ইনসাফ, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চাচ্ছি।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *