জোবায়েদকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে মাহির ও বর্ষা

■ নাগরিক প্রতিবেদন ■

রাজধানীর পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেনকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন মাহির রহমান ও বার্জিস শাবনাম বর্ষা।

জোবায়েদ হোসেনকে হত্যার পরিকল্পনা প্রায় এক মাসে আগেই করেছিল তাঁর ছাত্রী ও তার বন্ধু মাহির রহমান। মাহিরের ছুরিকাঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান জোবায়েদ। তবে মৃত্যুর আগে জোবায়েদ তাঁর ছাত্রীর কাছে শেষ মুহূর্তে বাঁচার আকুতি জানান। এ সময় জোবায়েদকে ছাত্রী বলে, ‘তুমি না সরলে আমি মাহিরের হতে পারব না।’ এর কিছু সময় পরই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান জোবায়েদ।

এ ঘটনায় ওই ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা, তার বন্ধু মো. মাহির রহমান ও তাঁর বন্ধু ফারদিন আহমেদ আইলানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, প্রেমের দ্বন্দ্ব থেকে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। বর্ষার সঙ্গে মাহিরের ৯ বছরের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে বর্ষা ও জোবায়েদের সম্পর্ক হয়। এতে মাহির ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন।

ওসি আরও বলেন, সম্পর্কের টানাপোড়েনের একপর্যায়ে বর্ষা প্রথমে মাহিরকে প্রত্যাখ্যান করলেও পরে আবার যোগাযোগ করে জানান, জোবায়েদকে তাঁর আর ভালো লাগে না। পরে জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বর্ষা ও মাহির।

মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন করেন অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন নজরুল ইসলাম ও ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী। ‎

‎অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, মাহির একই ভবনে ভাড়া থাকতেন। মাহির ও ওই ছাত্রীর দীর্ঘদিনের পরিচয়। তবে তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে দেড় বছর আগে। জোবায়েদ এক বছর ধরে ওই মেয়েকে পড়াতেন। পড়ার সময় জোবায়েদের প্রতি দুর্বল হয়ে যায় সে। এমন অবস্থায় মাহিরকে ওই ছাত্রী বলে, ‘জোবায়েদকে না সরাতে পারলে আমি তোমার হতে পারব না।’ এভাবেই তারা জোবায়েদকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। ‎

পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ওই ছাত্রী একই সময়ে তার গৃহশিক্ষক জোবায়েদ ও মাহিরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। গত ২৬ সেপ্টেম্বর মাহির বিষয়টি নিয়ে মেয়েটিকে চাপ প্রয়োগ করলে সেদিনই গৃহশিক্ষক জোবায়েদকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে তারা। পরে মাহির ও তাঁর বন্ধু আইলান চাকু কিনে গত রোববার (১৯ অক্টোবর) ওই মেয়ের বাসার নিচে অবস্থান নেন। আর মেয়েটি তার শিক্ষক জোবায়েদকে ডেকে আনে। এরপরই মেয়েটির বাসার সিঁড়িঘরে মাহির জোবায়েদকে বলেন, ওই ছাত্রীকে যেন ভুলে যান। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক হলে জোবায়েদ বলেন, ‘সে তো আমাকে পছন্দ করে।’ একপর্যায়ে জোবায়েদকে চাকু দিয়ে গলায় পোচ দেন মাহির।

মল্লিক আহসান বলেন, জোবায়েদের প্রতি বেশি দুর্বলতা থাকলেও মেয়েটি একই সঙ্গে মাহির ও জোবায়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল। ত্রিভুজ প্রেম থেকে বের হতে নিজেই হত্যার পরিকল্পনা সাজায় মেয়েটি।

‎মাহিরকে তাঁর মা থানায় হস্তান্তরের বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে আসামি গ্রেফতারে পুলিশের নানা ধরনের কৌশল থাকে। আগে চট্টগ্রামের রাউজানে নিয়মিত শিক্ষার্থী অপহরণ হতো, মুক্তিপণ আদায় করা হতো। আমরা তখন অপহরণকারীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসে তাদের ব্যবহার করে সমঝোতার চেষ্টা করতাম। ঠিক এভাবেই আমরা মাহিরকে থানায় দিয়ে যেতে চাপ প্রয়োগ করেছি। এটা আমাদের কৌশলের অংশ। স্বেচ্ছায় থানায় হস্তান্তর করা হয়নি।’

এক প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, হত্যার পুরো পরিকল্পনা করেছে মেয়েটিই। বরগুনার মিন্নির ঘটনার সঙ্গে অনেকাংশ মিল রয়েছে। মেয়েটা দুজনের কারও কাছ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। ফলে সে নিজেই হত্যার পরিকল্পনা সাজায়।

‎হত্যার পরিকল্পনায় রাজনৈতিক কোনো বিষয় ছিল কি না—জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, মাহির ও মেয়েটি ২৬ সেপ্টেম্বর হত্যার পরিকল্পনা করে। এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় নেই। এটা ত্রিভুজ প্রেমের ঘটনা।

‎হত্যার মুহূর্তে জোবায়েদকে মেয়েটির শেষ কথার বিষয়ে লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান বলেন, ‘মেয়েটি আমাদের নিশ্চিত করেছে যে জোবায়েদ মারা যাওয়ার সময় সে উপস্থিত ছিল।’

প্রাথমিক ‎তদন্তের বরাতে পুলিশ জানায়, জোবায়েদের শেষ কথা ছিল মেয়েটির উদ্দেশে—’আমাকে বাঁচাও।’ মেয়েটি তখন জোবায়েদের উদ্দেশে বলে, ’তুমি না সরলে আমি মাহিরের হব না’। তদন্তে প্রকাশ পায়, দোতলার সিঁড়িতে জোবায়েদকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ সময় তিনি বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন। মেয়েটির বাসা পাঁচতলায় হলেও ঘটনার সময় সে তিনতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিচের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছে।

‎জোবায়েদ দোতলার কলিং বেল বাজিয়ে দরজায় ধাক্কা দেন। দরজা থেকে রক্ত নিচে গড়িয়ে পড়ছিল।

জোবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনায় কৃষ্ণপুর গ্রামে। গতকাল জোবায়েদকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *