■ মাশরিন জাহান মনি ■
এ জীবনে আমি প্রেমে পরেছিলাম দুইবার।
একবার বই এর, দ্বিতীয়বার এক নাম না জানা মানুষের।
২০১১ সালের কথা। আমার তখন সবেমাত্র এসএসসি শেষ। তিনমাসের বিশাল ছুটি পেয়েছি। এই তিনমাস ভালোভাবে কাটানোর জন্য অনেক গুলো লেখকের লিস্ট করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম এক এক করে পড়ব সব। কিন্তু বাধ সাধলো ছোটোমামার পাঠানো পার্সেল। মামা লন্ডনে থাকতো তখন। বছরে দুইবার বিশাল পার্সেল পাঠাতো। সেখানে সবার জন্যই কিছু না কিছু থাকতো।
সেবারে আমার জন্য এলো একটা ল্যাপটপ। আস্ত একটা ল্যাপটপ। ল্যাপটপ তখন খুব রেয়ার। কাজেই ল্যাপটপ হাতে পেয়ে আমি যেন আকাশের চাঁদ পেলাম। একদিকে তিনমাসের ছুটি, আরেকদিকে নতুন ল্যাপটপ-একদম সোনায় সোহাগা যাকে বলে।
২০১১-তেই ফেসবুক আইডি খুললাম, একদম কৌতুহল এর বশে। বাসার কেউই জানেনা। সেসময় ফেসবুক চালানোটা মনে হতো বিশাল অপরাধের কিছু। তার ওপর আমি মেয়ে। তখনের দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিলো যে ভালো মেয়েরা ফেসবুক চালায়? একারণে ফেইক একাউন্ট খুললাম। নাম দিলাম ‘’দীপাবলির সাতকাহন”। সবেমাত্র উপন্যাসটা শেষ করেছি। আমার চোখেমুখে তখন দীপাবলির ঘোর। স্বপ্নে জলপাইগুড়ি ঘুরে বেড়াই, কোলকাতা চষে বেড়াই। আর বাস্তবে ঘাঁটি ফেসবুক। নতুন নেশা হয়ে গেলো এই ফেসবুক।
সাতকাহন মানে কি সেটা তখনো জানতাম না ভালো করে। ভেবেছিলাম সাতকাহন মানে সাতটা কাহিনি। কিন্তু আসল অর্থটা জানালো সেই মানুষটা। যার নাম আমি জানিনা, দেখতে কেমন জানিনা, কোথায় থাকে তাও জানিনা। কিন্তু ওই কাঁচাবয়সে এমনভাবে তার প্রেমে পরে গেলাম যে এ জীবনে আর কাউকে ভালো লাগলোনা!
আমাদের প্রেম হওয়ার কথা ছিলোনা। যদিও আমরা রাতজেগে অনেক গল্প করতাম। কিন্তু আমাদের নিজস্ব কোনো অনুভূতি ছিলোনা সেসব গল্পে। আমরা কেউ নিজেদের গল্প করতাম না। সদ্য এসএসসি পাশ করা একটা মেয়েকে উনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন চার্লস বুকোস্কির সাথে, বুদ্ধদেব বসুর সাথে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাথে, কাফকার সাথে, নেরুদার সাথে, লিওনার্ড কোহেনের সাথে, বব ডিলানের সাথে, রবার্ট ফ্রস্টের সাথে। মন খারাপের সব কবিতার সাথে। আমি ভেবেছিলাম উপন্যাস আমার সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু উনি আমাকে অদৃশ্য আঙুল ছুঁয়ে নিয়ে গেলেন কবিতার রাজ্যে। কি সব মন খারাপ করা কবিতা পড়াতেন!
মানুষটার ফেসবুক একাউন্টের নাম ছিলো ‘কালকূট’। শুধু এতটুকুই। অদ্ভুত লেগেছিলো। একসেপ্ট করতেই তিনি নিজে থেকেই মেসেজ দিলেন। শুরুর দিকের কথাগুলো খুব স্পষ্ট মনে করতে পারিনা এখন। কিন্তু যতটুকু মনে পরে আমার আইডির নাম নাকি ইউনিক লেগেছিলো তার কাছে। এমনটা নাকি সচরাচর দেখা যায়না ফেসবুকে। সেই মানুষটার কাছেই জানলাম সাতকাহন অর্থ সাতটা কাহিনি না। কাহন একটি পরিমাপের একক। কিভাবে গুণভাগ করে বুঝিয়েছিলেন পুরোপুরি মনে নেই। কিন্তু সাতকাহন এর শাব্দিক অর্থ তিনি করে দিলেন- ‘’অপরিমাপযোগ্য’’
এই মানুষটা দুইদিনের মাথায় আমার ঘুম হরণ করে নিলেন।
সারাটা রাত মেসেজে কথা বলতাম আমরা। আমার বয়স তখন ১৬, ফেসবুকে দেয়া ১৮। মানুষটার বয়স ফেসবুকে দেয়া ২১, বাস্তবে কত জানিনা। আমি সদ্য এসএসসি পাশ করা কিশোরী। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ। উনার সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ, থার্ড ইয়ার। আর কিচ্ছু না। আমি তার চেহারা দেখিনি। নাম জানিনা।
শুধু জানি একটা শব্দ- কালকূট। পরে উনি বলেছিলেন কালকূট শব্দ অর্থ বিষ। সেই কালকূট আমি পান করেছিলাম ২০১১ সালে। আজও আমার পুরো শরীর কালকূটে নীল হয়ে আছে।
আমাদের প্রেম হওয়ার কথা ছিলোনা। যদিও আমরা রাতজেগে অনেক গল্প করতাম। কিন্তু আমাদের নিজস্ব কোনো অনুভূতি ছিলোনা সেসব গল্পে। আমরা কেউ নিজেদের গল্প করতাম না। সদ্য এসএসসি পাশ করা একটা মেয়েকে উনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন চার্লস বুকোস্কির সাথে, বুদ্ধদেব বসুর সাথে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাথে, কাফকার সাথে, নেরুদার সাথে, লিওনার্ড কোহেনের সাথে, বব ডিলানের সাথে, রবার্ট ফ্রস্টের সাথে। মন খারাপের সব কবিতার সাথে। আমি ভেবেছিলাম উপন্যাস আমার সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু উনি আমাকে অদৃশ্য আঙুল ছুঁয়ে নিয়ে গেলেন কবিতার রাজ্যে। কি সব মন খারাপ করা কবিতা পড়াতেন!
আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘জানো দীপা, কবিতার সবচেয়ে সুন্দর নাম কবিতা।’
আমি বুঝতাম না ভালো করে। উনি বোঝাতেন, ‘ইংরেজিতে কবিতাকে বলে পোয়েট্রি। উর্দুতে শায়েরি, আরবিতে আশশির, জার্মানে গেদিখট, রাশিয়ানে স্তিখাতাভরেনিয়ে, চায়নিজে শি। কি অদ্ভুত নাম, তাইনা?
তোমার বুকের ভেতর ঝড়, তোমার বুকের ভেতর ধূ ধূ শূন্যতা, তোমার বুক যুদ্ধাহত রক্তাক্ত ময়দান। তুমি এসবের প্রতিফলন ঘটাবে যেখানে, সেটার নাম যদি পোয়েট্রি হয়, গেদিখট হয়, স্তিখাতাভ্রেনিয়ে হয়, তাহলে ভালো লাগবে? কিন্তু বাংলা ভাষায় দেখো, আমরা একে বলি কবিতা। কি সুন্দর, তাইনা?’
তার সাথে আমার কথোপকথন এগোতো, আর আমার মধ্যরাত ভরে উঠতো একশ একটা নক্ষত্রে। উনি আমাকে বলতেন, ‘দীপা জানো, নক্ষত্রেরও মৃত্যু হয়?’
আমি হেসে বলি, ‘ জানিতো। জীবনানন্দ দাশ তো বলেই গেছেন, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়..’
উনি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠেন, ‘উহু, কবিতায় নয় দীপা। সত্যি সত্যি নক্ষত্র মরে যায়। সুপারনোভা মরে গেলে প্রচন্ড বিকিরণ ছড়ায়। পৃথিবী থেকেও দেখা যায় সেটা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সেই আলো পৃথিবীতে আসতে লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায়। কখনো যদি দেখো রাতের আকাশ দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে গেছে, তাহলে বুঝবে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে কোন একটা নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটেছে। সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাকে পরবে তোমার?’
প্রতিরাতে আমাদের গল্প হতো। রাশিয়ান কোনো কবি, কোনো লেখক, কোনো বই, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি সবকিছু নিয়ে কথা বলতাম আমরা।
আমার প্রথম প্রেম ছিল বই। উনার সাথে পরিচয় এর পরে আমার সেই প্রেম আরো শক্ত হলো। কিন্তু এবারে বই এর প্রতি নিখাদ টান থেকে নয়। বরং তার সাথে প্রত্যেকটা কথা আমাকে বই এর দিকে ফিরতে বাধ্য করতো। এত সুন্দর করে গল্প করতে পারতেন উনি!
এই গল্পের মায়া আমাকে তার প্রেমে ফেললো। আমার বয়সটা তখন কাঁচা। কিন্তু আমি জানি যেকোনো বয়সের কেউই তার সাথে একবার কথা বললেই তার প্রেমে পরতে বাধ্য।
আমার দ্বিতীয় প্রেম হলেন সেই মানুষটা। কিন্তু এই মানুষটাও যে আমার প্রেমে পরে যাবেন, এমনটা কখনো ভাবিনি আমি। কিন্তু সেটাই হলো। আমরা দুজন তীব্রভাবে দুজনের প্রেমে পরে গেলাম।
আমি তার চেহারা দেখিনি। নাম জানিনা। মানুষটা আমাকে ডাকেন দীপা বলে।
তাকে বলতে ইতস্তত করি, যে আমার নাম দীপা না। আমার নাম খুব সেকেলে- চামেলী। পাছে আমার নাম চামেলী জেনে উনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলুক! তবুও একদিন খুব দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার প্রিয় ফুল কোনটা?
তিনি খুব চালাকি করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার প্রিয় ফুল দীপা’
কেঁপে উঠেছিলাম অজানা এক অনুভূতিতে! জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘’চামেলী ফুল কেমন লাগে আপনার?’’
উনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী ফুল হলো চামেলী। বর্ণহীন, হালকা সুগন্ধ, টুপ করে মাটির বুকে মুখ গুজে পরে থাকে। কবিতার যদি চেহারা থাকতো, তাহলে তা দেখতে হতো চামেলী ফুলের মতো।’
শুনে আমার হৃদয় ভরে ওঠে ভালোবাসায়। বলতে ইচ্ছে করে আমিই সেই কবিতা, আমিই সেই চামেলী। আপনি মাটি হয়ে আমার জন্য বুক পেতে থাকবেন?
বলা হয়ে ওঠেনা। বলা হয়ে ওঠেনা যে আমার বয়স আঠারো না। আমি সবে ষোলো পার করেছি। বলা হয়ে ওঠেনা, আমি এসএসসি দিয়ে কলেজে উঠলাম। সময় গড়ায়। দুটো মানুষ কেউ কাউকে না দেখে ভালোবেসে যেতে থাকে। স্বপ্ন দেখতে থাকে। একটা বিকেলের। একটা নদীর।
‘তুমি ময়ুরাক্ষী নদীর নাম শুনেছো?’
আমি হ্যাঁ বলি। উনি বলেন, ‘হিমুর ছিলো ময়ুরাক্ষী নদী, আমার আছে চিত্রা নদী। চিত্রা নদীর পাশে বসে তোমাকে আমি আমার লেখা গান শোনাবো।’
আমি কল্পনায় চিত্রা নদীর ছবি আঁকি।
২০১১ পেরিয়ে ২০১২ আসে। দিনটা এখনো মনে আছে। ফেব্রুয়ারীর ২৯ তারিখ। উনি আমাকে বলেছিলেন পরের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে আমাকে নিয়ে চিত্রার পাড়ে যাবেন। উনি পরবেন নীল পাঞ্জাবি, আর আমি সাদা খোলের শাড়ি। আমার হাত ধরে বসে থাকবেন পুরো বিকেল, সন্ধ্যা। তারপর আমরা ফিরব একই বাড়িতে। ছোট্টো একটা রুম হবে আমাদের। একটা বুকশেলফ, একটা রকিং চেয়ার, একটা ওক কাঠের টেবিল, দুটো মাটির চায়ের কাপ, আর একটা বিছানা-আমাদের। তারপর যে কথাটা বলেছিলেন, সেটা শুনে লজ্জায় কান গরম হয়ে গিয়েছিলো আমার।
আমাদের কাল্পনিক সংসার চলছিলো। আমি ততদিনে পূর্ণেন্দু পত্রী পড়তে শিখে গেছি। আমি তাকে ডাকি শুভঙ্কর। আর তিনি আমাকে নন্দিনী। আমি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে টাইপ করি, ‘তুমি আজকাল বড্ড সিগারেট খাচ্ছো, শুভঙ্কর।’
ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসে, ‘এক্ষুণি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি, কিন্তু তার বদলে?’ আমি লজ্জায় ল্যাপটপ বন্ধ করে রাখি।
আমাদের দেখা করার কথা চলছিলো। আমাদের বাসাটা পুরানা পল্টনে। আর শুভঙ্কর থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। দেখা করার দিনক্ষণ ঠিক করা হচ্ছিলো। আমাদের প্রথম দেখা। স্মরণীয় হতে হবে। আকাশ মেঘলা থাকতে হবে। যেন আমাদের দেখা হওয়া মাত্রই ঝুম বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে ভিজে দুজন হাঁটবো-বেইলি রোড, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফুলার রোড। দুজনের চুল থেকে টপটপ করে পানি পরবে। তারপর শুভঙ্কর আমার চুলের পানি ঝেড়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করবে, ‘’এমনও দিনে তারে বলা যায়.. এমনও ঘনঘোর বরষায়’’
কিন্তু তার কিচ্ছু হলোনা। এক রাতে বাবা আমার ল্যাপটপ আছাড় মেরে ভেঙে ফেললো। ভাঙবে না-ই বা কেন!
সাতটা বছর অপেক্ষা করেছি। সাত বছরে আমার কলেজ শেষ, অনার্স শেষ, মাস্টার্সও শেষ। বেসরকারি একটা কলেজে ঢুকেছি লেকচারার হিসেবে। বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় করছে। কিন্তু পাত্র পছন্দ হচ্ছে না আমার। হবে কী করে? শুভঙ্কর যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়ে গেছে, ওর ধারেকাছেও তো কাউকে পাইনা। অথবা হয়তো খুঁজিইনি। একের পর এক পাত্র রিজেক্ট করতে থাকলাম। কারণ একটাই- ওদের মধ্যে কেউ জানতো না কবিতার রাশিয়ান প্রতিশব্দ কী, কেউ জানতো না কোন ফুল কবিতার মতো বিষণ্ণ, কেউ জানতো না নক্ষত্রের মৃত্যু হলে কী হয়।
ওই বয়সী একটা মেয়ে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিনরাত ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে, খটাখট করে টাইপ করে, রহস্যময় ভঙ্গিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাসে, রাতে ঘুমায় না। এসব লক্ষণ বাবা-মা বুঝবে না?
কয়েকদিন পর মোড়ের কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে আমি চেষ্টা করেছিলাম আমার ফেসবুকে লগিন করার। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে আমার একাউন্টের পাসওয়ার্ড কী ছিল আমি ভুলে গেছি। মনে করার চেষ্টা করলাম কতভাবে, মনে হলোনা!
এবং আমি বুঝে ফেললাম শুভঙ্করকে হারিয়ে ফেলেছি আমি।
এরপর শুভঙ্করের সাথে আমার সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। দেড় বছর এর পরিচয়, ছয় মাসের প্রেম। প্রেমের কোনো ইতি টানিনি আমরা। কেউ কারো হৃদয় ভাঙিনি। ঝগড়া করে মান অভিমান করিনি। কিন্তু আমাদের প্রেম থমকে গেলো। যেন একটা রেলগাড়ি ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে মাঝপথে থেমে আছে।
কোনোভাবেই পারিনি শুভঙ্করের সাথে যোগাযোগ করতে। শুধু বারবার মনে হতো শুভঙ্কর জানেনা কেন তার নন্দিনী যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো, সে জানেনা কেন তার দীপাবলির সাতকাহন থেমে আছে। এটা ভেবে কষ্ট আরো বেশি পেতাম। কলেজ ফাঁকি দিয়ে ছুটে যেতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা বিভাগে। কেউ বুঝতো না কেন কলেজড্রেস পড়ুয়া একটা মেয়ে ভার্সিটির বারান্দায় ঘুরঘুর করছে, ক্লাসরুমে উঁকি দিচ্ছে। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতাম ফুলার রোডে, ভিসি চত্বরে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। কেউ একটু কৌতুহলী চোখে তাকালে দৌঁড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, আপনি কি জানেন জার্মান ভাষায় কবিতাকে কী বলে?
ভার্সিটির প্রায় অর্ধেক ছাত্রছাত্রী জেনে গেলো নীল সাদা ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়ে সবাইকে কবিতার কথা জিজ্ঞেস করছে। তবুও শুভঙ্করকে খুঁজে পাইনি আমি।
এরপর খুব জেদী হলাম পড়াশোনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হলাম। ভার্সিটিতে এসে প্রথম একটা নিজের ফোন হলো। আসল ফেসবুক একাউন্ট হলো একটা। হাজারবার ‘কালকূট’ লিখে সার্চ করেছি। কিন্তু পাইনি আমার কালকূটকে। যেন এক পাহাড়সম অভিমান বুকে নিয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
এই আমিই আবার প্রেমে পরলাম। তৃতীয়বারের মতো। এবারে এক জলজ্যান্ত মানুষের। শ্রাবণ মাসের এক ঝুম বৃষ্টির সন্ধ্যায় তার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। তার নাম মুনিম। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, চোখে ভারী পাওয়ার এর চশমা, মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ, কবি কবি চেহারা। মন খারাপ হলে এই লোকটা গলার স্বর বাচ্চাদের মতো করে আমাকে সুকুমার রায়ের ছড়া শোনায়। আমি হেসে ফেলি। ভালোবেসে ফেলি। আরেকবার।
ভার্সিটিতে আসার পর কালকূটকে খোঁজার চেষ্টা আবার শুরু করেছিলাম। ওর কথা শুনে মনে হতো ও থিয়েটার করতো, আমি ঢাবির নাট্য সংসদে যোগ দিলাম। ওর যুক্তিতর্কের উপস্থাপনা দেখে আমার মনে হতো ও বিতর্ক করতো। আমি বিতর্ক সংসদে যোগ দিলাম। ওর চিন্তাধারা মনে হতো বামপন্থী। আমি ধীরে ধীরে বাম রাজনীতির সাথেও জড়িয়ে পরলাম। উদ্দেশ্য একটাই। কোনোভাবে যদি ওর কোনো খোঁজ পাই আমি!
বাংলা বিভাগে নিয়মিত যাতায়াত করতাম। যদিও ততদিনে কালকূটের অনার্স মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা! তবুও মনে ক্ষীণ আশা ছিলো, যদি কোনো খোঁজ পাই!
পাইনি খুঁজে।
সাতটা বছর অপেক্ষা করেছি। সাত বছরে আমার কলেজ শেষ, অনার্স শেষ, মাস্টার্সও শেষ। বেসরকারি একটা কলেজে ঢুকেছি লেকচারার হিসেবে। বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় করছে। কিন্তু পাত্র পছন্দ হচ্ছে না আমার। হবে কী করে? শুভঙ্কর যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়ে গেছে, ওর ধারেকাছেও তো কাউকে পাইনা। অথবা হয়তো খুঁজিইনি। একের পর এক পাত্র রিজেক্ট করতে থাকলাম। কারণ একটাই- ওদের মধ্যে কেউ জানতো না কবিতার রাশিয়ান প্রতিশব্দ কী, কেউ জানতো না কোন ফুল কবিতার মতো বিষণ্ণ, কেউ জানতো না নক্ষত্রের মৃত্যু হলে কী হয়।
আত্মীয় স্বজন, আমার কলিগরা- অনেকেই এরমধ্যে ভাবা শুরু করেছে বই পড়তে পড়তে আমি পাগল হয়ে গেছি। এরমধ্যেই একদিন এক কলিগের বাসায় দাওয়াত পেলাম। তার মেয়ের জন্মদিন। যেতেই হবে।
যেতাম না। এসব ভীড়, হৈচৈ আমার ভালো লাগেনা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী মনে করে যেন গেলাম। ভাগ্যিস গেলাম!
জন্মদিনের উৎসব। চারপাশে উজ্জ্বল আলো, অসংখ্য বেলুন, আমরা কয়েকজন কলিগসহ তাদের কিছু কাছের আত্মীয়, আর অনেক বাচ্চাকাচ্চার হৈ হুল্লোড়। কেক কাটা হবে।
সমস্ত লাইট নিভে গেলো। জ্বলে উঠলো অনেকগুলো মোমবাতি। সেই মোমের আলোয় আমি দেখলাম চোখদুটো। আগুনের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ধূসর চোখের মণিতে। কি ছিলো ওই চোখে, কে জানে! আমি চোখ ফেরাতে পারিনি।
চোখাচোখি হয়ে গেলো। সেই চোখদুটোও তাকিয়ে রইলো আমার দিকে একদৃষ্টে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো আমার। অনেকদিন পর। আর অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হলো একটা শব্দ- কালকূট!
না, কালকূট এর চেহারা আমি দেখিনি কোনোদিন। ওর চোখ কেমন আমি জানিনা। যে মানুষটির চোখের দিকে আমি সেই সন্ধ্যায় তাকিয়ে ছিলাম, সেই মানুষটার নাম মুনিম।
মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ, মুখভর্তি দাঁড়ি গোঁফ, আর ঠোঁটের কোণায় একটা হাসি। মানুষটির সাথে আমার কথা হয়নি সেদিন। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো এই মুনিমই আমার কালকূট।
তারও অনেক পরে একদিন আবার বিয়ের প্রস্তাব এলো একটা।
পাত্র আর কেউই নয়- মুনিম নামের মানুষটা।
আমাদের কথা বলতে দেয়া হলো আলাদা করে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘চামেলী, বলো তো, পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ণ ফুল কোনটা?’
আমি চমকে উঠে তাকালাম তার দিকে, পূর্ণদৃষ্টিতে। মানুষটা হাসছে। মনে হলো এই হাসি আমার চিরচেনা। হঠাৎ আমার হৃদস্পন থেমে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। চোখ ভর্তি হয়ে গেলো জলে। আমি যন্ত্রের মতো বললাম, ‘’পৃথিবীর সবচেয়ে মন খারাপ করা ফুল হলো চামেলী, বিষণ্ণ কবিতার মতো, একরাশ দুঃখ বুকে নিয়ে যে মাটির বুকে ঝরে পরে’’
এরপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবিতার রাশিয়ান প্রতিশব্দ কী বলো তো?’
হঠাৎ আমি দেখলাম আমি কাঁদছি। কথা বলতে পারছিনা। মুনিম একটু হেসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমি তখন পাগলের মতো বলে যাচ্ছি, ‘আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি, কালকূট। কোথাও খুঁজে পাইনি। আমার ল্যাপটপটা ভেঙে ফেলেছিলো বাবা। আমি আমার আইডির পাসওয়ার্ডও মনে রাখিনি। আমি পারিনি আপনার সাথে যোগাযোগ করতে।’
আরও কতক্ষণ একনাগাড়ে বলে গেলাম সব। কিভাবে কিভাবে খুঁজেছি, কতদিন কোথায় বসে থেকেছি, সবটা। মুনিম আমার হাত ধরে চুপচাপ পুরোটা শুনে গেছে। আমার সব কথা শেষ হলেও চুপ করে থাকলেন তিনি। তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি এসে গেছি তো, এখন সব ঠিক হয়ে যাবে’
২০২০ এর শ্রাবণ মাসের এক সন্ধ্যায় বিয়ে হলো আমাদের। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। কারেন্ট চলে গেছে। মোম জ্বালানো হয়েছে দুই একটা। সেই মোমের আলোয় আমি কবুল বলে রেজিস্ট্রি খাতায় সই করে চিরদিনের জন্য মুনিমের হয়ে গেলাম। কি রূপকথার মতো সবকিছু!
বাসররাতে সারারাত গল্প করেছি আমরা। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম যে মানুষটা মেসেজে এত বকবক করতো, সে বাস্তব জীবনে খুব চুপচাপ। আমিই বলে যাচ্ছি সব।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিভাবে খুঁজে পেলেন আমাকে?’
মুনিম আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে উত্তর দিলো, ‘যেদিন আকাশভর্তি তারা থাকবে, যে রাতে আমাদের কারো কোনো দীর্ঘশ্বাস থাকবে না, সেদিন তোমাকে সব বলবো।’
এরপর পার হয়ে গেছে অনেকদিন। মুনিম কিছুই বলেনি আমাকে।
আমার মাঝেমাঝেই মনে হয় মুনিমকে আমি যতটা হৃদয়ে ধারণ করেছিলাম, ততটা হয়তো ও করতে পারেনি। ওর সাথের প্রত্যেকটা স্মৃতি এখনো আমার কাছে জীবন্ত। অথচ ও ভূলে গেছে অনেককিছুই। হুটহাট করে মাঝরাতে জিজ্ঞেস করে বসে,
‘বলোনা চামেলী, আমরা কোথায় দেখা করতে চেয়েছিলাম?’
‘তোমাকে কি রঙের শাড়ি পরতে বলেছিলাম?’
‘তোমাকে কি আমার ছোটবেলার গল্প করেছিলাম?’
‘বিয়ের পর আমাদের কোথায় যাওয়ার কথা ছিলো?’
আমার অভিমান হয়, কেন ও এসব মনে রাখেনি! কিন্তু সাত আট বছর তো কম সময় নয়! ভূলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
এই ভূলে যাওয়া স্বভাবটা বাদে মুনিমের তো আর কোনোদিকে কমতি নেই! এত ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছে ও আমাকে! এত যত্ন আমাকে কেউ কোনোদিন করেনি। সাত আট বছর আগের মধ্যরাতে যেমন ‘কালকূট’ এর সাথে কথা বলে আমার রাত ভরে উঠতো একশ একটা নক্ষত্রে, এখন সবগুলো নক্ষত্র যেন আমার ছোট্ট ঘরটায়। দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট। একটা বড় বেলকনি। বেলকনিতে একটা রকিং চেয়ার।
দুজন অফিস শেষ করে ফিরি একই বাড়িতে। একই রুমে। রুমে একটা বুকশেলফ, বুকশেলফ ভর্তি বই, একটা ওক কাঠের টেবিল, দুটো মাটির চায়ের কাপ, আর একটা বিছানা-আমাদের।
ঠিক যেমনটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার প্রত্যেকটা ও পূরণ করেছে। আমার শূন্য হৃদয় ভালোবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলো, মুনিম শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসেছে সেই তৃষ্ণা মেটাতে।
সবকিছু সুন্দর চলছিলো। মাঝে মাঝে আমি জোর করি ‘বলবে না আমাকে কিভাবে খুঁজে পেয়েছো?’
মুনিম এড়িয়ে যায়। আমি বুঝি ও দিনক্ষণ ঠিক করে এরপর বলবে।
এরপর এলো সেই সময়টা। একরাতে প্রবল আদর শেষে আমাকে বুকের সাথে চেপে নিয়ে ও বললো, ‘চামেলী, একটা মিথ্যা কথা বলেছি তোমাকে। আমি তোমার কালকূট নই। আমি শুভঙ্কর নই। কখনোই ছিলাম না। আমি শুধু মুনিম’
আমি হেসে উড়িয়ে দিই।
কিন্তু ও আমাকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে। আমাকে শোনায় সবটা। বলে কিভাবে খুঁজে পেয়েছে আমাকে। সেই সেদিনের চোখাচোখির পর আমাকে ভালো লেগে যায় তার। তাই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো।
আমি তড়িতাহতের মতো স্থির হয়ে যাই। চোখভর্তি জল নিয়ে জিজ্ঞেস করি কেন তাহলে কালকূট সাজার নাটক করেছিলো।
মুনিম উত্তর দেয়, ‘নাটক করিনি চামেলী। আমি শুধু খোঁজ নিয়েছিলাম তোমার ব্যাপারে। তোমার বাবা মা, ভাই এর সাথে কথা বলেছি আগে। তারা আমাকে জানিয়েছে তুমি এর আগে সব পাত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছো কারণ ওরা তোমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেনি। সবাইকে একই ধরনের প্রশ্ন করতে তুমি।
তোমার বাবা মা আমাকে পছন্দ করেছিলো। তারা চেয়েছিলো যেন এবারে অন্তত তুমি আর না করতে না পারো। তাই আগে থেকেই আমাকে বলে রেখেছিলো এসব। আমি তো জানতাম না তোমার এই কাহিনি। আমি শুধু ভেবেছিলাম তুমি আমাকে প্রশ্ন করার আগেই আমি তোমাকে এইসব প্রশ্ন করে ভড়কে দেবো।
কিন্তু তুমি আমাকে কালকূট ভেবে নিলে। একা একাই বলে গেলে সব। আমাকে কোনো কথা বলতে দাওনি। আমার শুধু দেখছিলাম জাহাজডুবী এক নাবিক আমাকে খড়কুটো ভেবে আঁকড়ে ধরছে। আমি কিভাবে তার বিশ্বাসটা ভাঙাতাম বলো?
আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
আমি চাইনি তোমাকে হারাতে। তাই তুমি যেভাবে খুশি থাকতে চেয়েছিলে, সেটাই করেছি। কাঁদবে না চামেলী, আমার দিকে তাকাও। দেখো, আমি কালকূট নই। কিন্তু তোমার মনে কালকূটের যে স্কেচটা ছিলো, তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি আমি।
কালকূট কোনো মানুষ নয়। কালকূট একটা চরিত্র, যে হারিয়ে গেছে। তবুও আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, যদি সত্যিই ও থেকে থাকে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, আমি ওকে খুঁজে বের করব।
এই চামেলী, তুমিও তো ভালোবাসো আমাকে। পারবে না এবারে সত্যিটা জেনে ভালোবাসতে?’
আমি পারিনি মুনিমকে আর সহজভাবে নিতে। অনেকদিন পার হয়ে গেছে। মুনিমের তুলনা হয়না। যেমন মানুষ সবাই চায় জীবনে, মুনিম তার থেকেও ভালো। খুব সুন্দর করে আবৃত্তি করে, চোখের দিকে তাকিয়ে কবিতা লিখে ফেলে, সহজ জিনিসকেও খুব সুন্দর করে তোলে ওর শৈল্পিকতা দিয়ে। কিন্তু তবুও আমি পারিনা ওকে পুরোপুরি মানতে।
আমার হৃদয়ে একটা প্রতারণার ক্ষত তৈরী হয়ে গেছে। মুনিমের ভালোবাসায় আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটটায় যে একশ একটা নক্ষত্র জ্বলে উঠেছিলো, সব খসে পরছিলো এক এক করে। আমি একদম চুপচাপ হয়ে গেলাম এরপর। ততদিনে বুঝতে পেরেছি কেন মুনিম আমাকে একবারও দীপা বলে ডাকেনি। আমার কান্না আসে। আমি কান্না লুকিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি। মুনিম বোঝে সবটা।
প্রতিরাতে আমাকে বুকে নিয়ে শিশুর মতো ঘুম পাড়ায়। চুলে বিলি কেটে কেটে ছড়া বলে। মজার মজার গল্প করে।
আমি মনকে বোঝাই, মুনিমেরই বা কী দোষ! আসলেই যদি আমি জানতাম ও কালকূট না, তাহলে তো আমাদের বিয়েটা হতোই না। যদি না হতো, তাহলে তো আমি জানতামই না সত্যিকারের ভালোবাসা কেমন, সত্যি সত্যি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মাটির কাপে চা খেতে কেমন লাগে। মুনিমের অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাকে একটু একটু করে ভুলিয়ে দেয় সব ক্ষত।
আমি আমার জীবনে আবার প্রেমে পরি।
সাতাশ বছর এর জীবনে আমি প্রেমে পরেছিলাম দুবার। একবার বই এর। দ্বিতীয়বার নাম না জানা এক মানুষের।
এই আমিই আবার প্রেমে পরলাম। তৃতীয়বারের মতো। এবারে এক জলজ্যান্ত মানুষের। শ্রাবণ মাসের এক ঝুম বৃষ্টির সন্ধ্যায় তার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। তার নাম মুনিম। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, চোখে ভারী পাওয়ার এর চশমা, মুখভর্তি দাঁড়িগোঁফ, কবি কবি চেহারা। মন খারাপ হলে এই লোকটা গলার স্বর বাচ্চাদের মতো করে আমাকে সুকুমার রায়ের ছড়া শোনায়। আমি হেসে ফেলি। ভালোবেসে ফেলি। আরেকবার।
মুনিমের হুটহাট আবদার। যখন তখন বলে শাড়ি পরো।
সেদিন সকালে হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললো, এই শাড়িটা পরে আসো। তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।
ব্যাগ থেকে বের করে দেখি একটা সাদা শাড়ি। খোলের শাড়ি। পাড়ে সুন্দর নকশা করা। আমার হাত থেমে যায়, সাদা খোলের শাড়ি। কালকূট বলেছিলো পরতে। আমার হুট করে খেয়াল হয় সেদিন ফেব্রুয়ারীর ২৯ তারিখ। ২০২৪ সাল।
হঠাৎ যেন আমি বুঝতে পারি মুনিম আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে কালকূট আমাকে বলেছিলো উনি পরের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে আমাকে নিয়ে চিত্রার পাড়ে যাবেন। উনি পরবেন নীল পাঞ্জাবি, আর আমি সাদা খোলের শাড়ি। আমার হাত ধরে বসে থাকবেন পুরো বিকেল, সন্ধ্যা। তারপর আমরা ফিরব একই বাড়িতে।
আমার খুব রাগ হয় মুনিমের ওপর। আমি চাইনা এসব স্মৃতি মনে করতে। কিন্তু ও বারবার মনে করায় আমাকে। ওকে শুরুর দিকে ‘কালকূট’ ভেবে বারবার বলতাম চিত্রার পাড়ে কবে নিয়ে যাবে।
কিন্তু ও তো কালকূট নয়। যে স্বপ্ন আমি অন্যজনের সাথে দেখেছিলাম, সে স্বপ্ন কেন ও পূরণ করবে? আমার রাগ হয়, জেদ হয়। ইচ্ছে করে শাড়ি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করি।
কিন্তু মুনিম আসে হাসিমুখে। নীল পাঞ্জাবি পরেনি। পরেছে সাদা পাঞ্জাবী। আমাকে শাড়ি পরায় জোর করে। হাত ধরে নিয়ে বসায় গাড়িতে।
চিত্রা নদী নড়াইলে। আমরা রওনা দিই এগারোটার দিকে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল। গাড়ি থেকে নেমে মুনিম আমাকে নিয়ে যায় চিত্রার পাড়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি চিত্রার দিকে। কালকূট বলেছিলো, ‘হিমুর ছিলো ময়ুরাক্ষী নদী, আমার আছে চিত্রা’
আমি কালকূটকে পাইনি। কিন্তু কালকূটের নদীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। চুপচাপ। মুনিম আমাকে দাঁড়াতে বলে সরে যায়।
আমি বুঝি স্পেস ও দিচ্ছে আমাকে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম কে জানে!
হঠাৎ শুনি কেউ ডাকছে, ‘দীপা!’
আমার হৃদপিণ্ড থেমে যেতে চায়। চকিতে ফিরে তাকাই। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে যে মানুষটা, তার বয়স চল্লিশের আশেপাশে। তিনি আমার অচেনা। কিন্তু তার এই ডাকটা আমার চিরচেনা। আমি অস্ফুটে উচ্চারণ করি, ‘কালকূট!’
মানুষটা হাসে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, গায়ের রঙ চাপা, তীক্ষ্ণ নাক, বড় একটা গোঁফ, আর তার নিচে ঠোঁট দুটো- অসম্ভব কালো।
আমি বিড়বিড় করে উঠি, ‘তুমি আজকাল বড্ড সিগারেট খাচ্ছো শুভঙ্কর!’
মানুষটা শুনে ফেলে। সাথে সাথেই উত্তর দেয়, ‘এক্ষুণি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি, কিন্তু তার বদলে?’
আমার লজ্জা লাগেনা আর। কান্না আসে। আমার কালকূট দাঁড়িয়ে আছে, আমার সামনে। বারো বছর পর!
একযুগ পর আমাদের দেখা হলো। চিত্রা নদীর পাড়ে।
কতক্ষণ ছিলাম? দুইঘন্টা, তিনঘন্টা, নাকি আরো বেশি?
আমি জানিনা। মুনিম আশেপাশে কোথাও ছিলোনা। শুধু একটা বিকেল, চিত্রার ঢেউ, আর কালকূট।
কালকূটের আসল নাম অর্ধেন্দু। অর্ধেন্দু রায়। অর্ধেন্দু রায়ই তো হওয়ার কথা। নাহলে তো কালকূট, শুভঙ্কর -এই নামগুলো আসতো না। নামদুটো যেন আরেকটু অর্থবোধক হয়ে ওঠে আমার কাছে। কালকূট অর্ধেন্দু রায়, আর কানিজ ফাতিমা চামেলী। কি এক অসম জুটি!
কালকূটের বয়স ৩৮।
বারো বছর আগে তার বয়স ছিলো ২৬। সদ্য মাস্টার্স করেছে সে। অথচ বয়স লুকিয়ে আমাকে বলেছিলো ২১। কারণ, ২৬ বছর বয়সে ১৮ বছর বয়সী মেয়েকে ভালো লেগেছিলো তার, বয়সের তফাত ছিলো আট বছর। কিন্তু সংকোচে বলতে পারেনি।
আমিও তো সংকোচে বলতে পারিনি আমার বয়স তখন ১৮ না, ছিলো ১৬। সবকিছু পরিষ্কার হয়ে আসে। আমি রাস্তায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম ২১ বছর বয়সী প্রেমিককে। আর কালকূট খুঁজেছে তার ১৮/১৯ বছর বয়সী প্রেমিকাকে। হাজারবার দুজন দুজনকে হয়তো পার করে গেছি, কিন্তু চোখে পরেনি এই কারণেই।
বেলা গড়ায়। সূর্য ডুবে যাবে যাবে ভাব। আমি ৩৮ বছর বয়সী অর্ধেন্দু রায়ের চোখে সূর্যের লাল আভা দেখি। ওরও গভীরে একটা সুক্ষ্ম বিষাদ, আমার চোখ এড়ায় না। অর্ধেন্দু সিগারেট ধরায়।
ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে আবৃত্তি করে, ‘’এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’’
সূর্য ডুবে যায়। আমরা ফিরি। অর্ধেন্দু যায় তার বাড়িতে, যেখানে তার অপেক্ষায় বসে আছে মাধুরী নামের এক সৌভাগ্যবতী, আর শতদল নামে একটা বছর ছয়েকের ছেলে।আমি ফিরি মেইন রোডে। শেষবারের মতো দুজন তাকাই দুজনের দিকে।
কালকূট অর্থ তীব্র বিষ।
আমাদের দুজনের চোখই নিরবে বলে দেয় আমাদের হৃদয়ের খুব গভীরে এক ছোট্ট কৌটায় আমরা কালকূট জমিয়ে রেখেছি।
আমরা ফিরি।
দুজন দুদিকে।
আমি চলে আসি গাড়ির কাছে। গাডিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সাদা পাঞ্জাবী পরা একজন মানুষ। এই মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আমার সব ছোটোখাটো ইচ্ছা পূরণ করা। আমি গিয়ে তার হাত ধরি। মানুষটা তাকায় আমার দিকে। আলতো হাতে চুল সরিয়ে দিয়ে চুমু দেয়। আমার হাত শক্ত করে ধরে মানুষটা ফিসফিস করে শোনায় গালিবের কবিতা, ‘যখনই দেখেছি তাকে আমি অন্য কারো সাথে, বুঝেছি খোদা কেন শিরক পছন্দ করেন না’
আমার সমস্ত ভার তার ওপর দিয়ে নির্ভার হয়ে তার কাঁধে মাথা রাখি। এরপর সন্ধ্যায় আধো আলো, আবছায়ায় আমরা ফিরি। একসাথে। এক বাড়িতে। ছোট্টো দুটো রুম। একটা বুকশেলফ, একটা রকিং চেয়ার, একটা ওক কাঠের টেবিল, দুটো মাটির চায়ের কাপ, আর একটা বিছানা-আমাদের।