■ নাগরিক প্রতিবেদক ■
৩৩ প্রাণ হারানোর শোকে তিন দফায় ১২ দিন বন্ধ থাকার পর রোববার সীমিত পরিসরে খুলেছে স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা ক্যাম্পাস। আগামী ৬ আগস্ট (বুধবার) থেকে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে। একই সঙ্গে পরবর্তী তিন মাস শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার উন্নয়নে কাউন্সেলিং কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। রোববার সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম।
গত ২১ জুলাই বেলা ১টা ৬ মিনিটে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। এরপর বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। এতে বৈমানিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সেদিনই ২২ জন নিহত হয়। এতে স্কুলটির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, আয়াসহ ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটে।
অধ্যক্ষ বলেন, ‘মূল পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে আগামী ৬ আগস্ট (বুধবার) থেকে। এর আগে আমরা শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির সুযোগ দিচ্ছি। শিক্ষকদের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামীকাল আনুষ্ঠানিক ক্লাস নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করার একটি ধাপ হিসেবেই দিনটি কাজ করবে। এ ছাড়া কালকে (৪ আগস্ট) আমাদের একটি পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা রয়েছে। অধিকাংশ অভিভাবক চাইছেন, শিক্ষার্থীরা যেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তাঁদের মতে, শিক্ষা কার্যক্রমে ফিরে এলে শিক্ষার্থীরা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। গত এক সপ্তাহ ধরে আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি, এই মুহূর্তে আমাদের পরিবারটি (মাইলস্টোন স্কুল) আহত এবং আমরা সবাই মানসিকভাবে কষ্টে আছি। আমরা সবার প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা এই কঠিন সময়ে আমাদের পাশে থেকেছেন।’
জিয়াউল আলম বলেন, ‘আমরা তাদের প্রত্যেকের নাম, পরিচয় ও ছবি যাচাই-বাছাই করে সংগ্রহ করেছি এবং আমাদের কলেজের ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটে একটি অফিশিয়াল তালিকা প্রকাশ করেছি, যাঁরা এই সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্ত ছিলেন বা বিভিন্ন গুজব শুনছিলেন, আশা করি এই তালিকা তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেবে। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মচারী এবং অভিভাবকদের নিয়ে গঠিত এই পরিবারে যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকেই আমরা কলেজের অংশ হিসেবেই মনে করি। তবে এর বাইরেও কেউ কেউ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন যেমন—বিমানের পাইলট বা পথচারী কেউ কেউ। তাঁদের পরিচয় এবং কলেজের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকায় আমরা তাঁদের কলেজের ক্ষয়ক্ষতির আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে রাখিনি।
এই মুহূর্তে কোনো শিক্ষার্থী নিখোঁজ নেই উল্লেখ করে অধ্যক্ষ বলেন, আপনারা যেভাবে আমাদের পাশে ছিলেন, যে সহানুভূতি ও সহযোগিতা দেখিয়েছেন, তার জন্য আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞ। আমরা শুধু এটুকুই চাই—এই কঠিন সময়ে সবাই যেন ধৈর্য ও সহমর্মিতার সাথে এগিয়ে আসেন এবং গুজব কিংবা অযাচিত আলোচনার বদলে বাস্তব সত্যের ওপর ভিত্তি করেই মূল্যায়ন করেন। এই মুহূর্তে আমাদের কোনো শিক্ষার্থী নিখোঁজ নেই।

ক্যাম্পাসের ভেতরে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে যে ভবনটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটি ঘিরে রাখা হয়েছে নীল রঙের টিন দিয়ে। শিক্ষার্থীরা সেই টিনে ঘেরা ভবনের সামনে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে।
সকাল থেকে অনেক শিক্ষার্থী এসেছে শোকের প্রাঙ্গণে। চিরচেনা কোলাহল-হৈ-হুল্লোড কিছুই নেই; কারও মুখে কোনো কথা নেই। কেউ কেউ সোজা চলে যাচ্ছে সেই টিনঘেরা অংশের কাছে। দাঁড়িয়ে থাকছে কিছুক্ষণ। কেউ চুপচাপ চোখ মুছছে, তারপর সরে যাচ্ছে সেখান থেকে। আশপাশে পায়চারি করছেন কয়েকজন কলেজকর্মী ও নিরাপত্তারক্ষী।
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিন আল রাব্বি বলেন, এই ভবনেই বাচ্চাদের ক্লাস হতো। এখনও বিশ্বাস হয় না, যেখানে তারা ক্লাস করত সেটা এভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে; এভাবে ঝরে গেছে আমাদের তাজা তাজা ফুলগুলো। প্রতিদিন কত হৈচৈ ছুটোছুটি হতো এখানে। কী থেকে কী হয়ে গেল!
আরেক শিক্ষার্থী রাইশা তাবাসসুম বলেন, দুর্ঘটনার কথা মোটেই ভুলতে পারছি না। আমরা অনেক বেশি শোকাহত। দীর্ঘদিন মনের মধ্যে এই শোক গেঁথে থাকবে।
রোববার সকাল ১০টা থেকে শিক্ষার্থীরা কলেজের মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকেন। কিন্তু সেদিনের মতো আজ নেই কোনো কোলাহল, নেই প্রাণচাঞ্চল্য। সকাল সাড়ে ১০টায় স্কুল প্রাঙ্গণে শুরু হয় মিলাদ মাহফিল ও শোকসভা। শ্রেণিকক্ষগুলোতে কিছু শিক্ষার্থীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়। কথা বলছেন ধীরে, বিনিময় করছেন পারস্পরিক কুশলাদি।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিরা বলে, ‘প্রতিদিন যে ভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে ক্লাসে যেতাম, আজ সেখানে শুধুই পোড়া গন্ধ আর শূন্যতা। আজ ক্লাস হয়নি, এসেছি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে।’
দশম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলে, ‘আমার পাশের বাসার এক ছোট ভাই এখানে ক্লাস করতো। আন্টি ছোট ভাইয়াটাকে আমার সঙ্গে পাঠাতেন। আমি বড়, ওর খেয়াল রাখতে পারবো এজন্য। ও এখন বার্নে ভর্তি। এখনো সুস্থ না। এখানে এসে ওর কথা বারবার মনে পড়ছে।’
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নওরোজ আফরিন বলেন, ‘কলেজে আসতে ভয় লাগছিল, তাও এলাম, আম্মু সঙ্গে এসেছে৷ পিচ্চিদের মুখগুলো চোখে ভাসছে। কান্না পাচ্ছে। এভাবে ওদের হারাতে হবে, তা কল্পনাও করিনি। হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেলো, ভাবতেই পারছি না!’
কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যেন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, এ জন্য সীমিত পরিসরে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছে, যা তাদের মানসিক প্রশান্তিতে সহায়তা করবে।’
তিনি আরও জানান, কলেজে বিমানবাহিনীর সহায়তায় একটি মেডিকেল ক্যাম্প চালু রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ পাচ্ছেন। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে নিয়মিত কাউন্সেলিং করছেন। কেউ চাইলে ব্যক্তিগতভাবে একান্ত আলাপের সুযোগ পাচ্ছে।
শাহ বুলবুল আরও বলেন, ‘এই দুঃসময়ে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সহানুভূতি ও মানবিকতা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠেছে।’